কেএনএফের আছে ‘হিটার গ্রুপ’, ১২০ হিটার চিহ্নিত
পার্বত্যাঞ্চলে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) দুর্ধর্ষ সদস্যদের চিহ্নিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নেমেছে। ইতিমধ্যে সংগঠনটির যারা হামলায় অগ্রভাগে থাকে এবং দুর্ধর্ষ তাদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ওই তালিকায় ১২০ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আক্রমণাত্মক এই কেএনএফ সদস্যদের নিয়ে রয়েছে হিটার গ্রুপ। তারা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংক, থানা ও বাজারে হামলার ঘটনায় জড়িত সদস্যদের শনাক্ত করতে সিসি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। ওই হামলায় কেএনএফের অন্তত ৪০ সদস্য অংশ নিয়েছিল। তাদের ধরতে যৌথবাহিনী বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। গতকাল কেএনএফের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে আটক করা হয়েছে।
সংগঠনটির প্রধান নাথান বমসহ ৩০ জনকে ধরতে পুলিশ বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে বলে পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল রবিবার বলেন, কেএনএফের বেশিরভাগ সদস্যই বিশেষ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ১২০ জনকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছেন। সংগঠনে তারা হিটার হিসেবে পরিচিত। তাদের কাছে একে-৪৭ রাইফেলসহ ভারী আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। তাদের ধরার জন্য যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও আলাদাভাবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কেএনএফের শীর্ষ একাধিক নেতা দেশের বাইরে আত্মগোপন করে আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাদের নামও পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের উচ্চপদস্থ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘কেএনএফকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। বিদেশ থেকে তারা অর্থ পাচ্ছে। সংগঠনটির সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণের ছবি হাতে পেয়েছি।’
গত বছর কেএনএফ ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে, যখন র্যাবের অভিযানে ইসলামপন্থি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। ওই সময় কেএনএফের সঙ্গে এই জঙ্গি সংগঠনটির যোগসাজশের বিষয়টি জানা যায়। কেএনএফের সহযোগিতায় ও অর্থের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলে ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিত কেএনএফ। ওই সময় শারক্বীয়ার নেতাসহ কয়েকজন জঙ্গি ধরা পড়ে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের আস্তানা। র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বান্দরবানে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বলা হয়েছে, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও সোনালী ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে সংলাপের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে আর কোনো ধরনের সংলাপ সম্ভব হবে না। পার্বত্য অঞ্চলে অপরাধ করলে কেউই ছাড় পাবে না। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে তাদের কঠোর হাতে দমনের পরামর্শ দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির বৈঠকও আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সুপারিশও আমলে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, একাধিক দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কেএনএফের যোগাযোগ রয়েছে। কেএনএফের মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে চাচ্ছে। এ কারণে তারা কেএনএফকে অস্ত্রসহ সবকিছু দিয়ে সহযোগিতা করছে। আবার পাহাড়ে নিজেদের মধ্যে চাঁদাবাজি ও ভূমি নিয়ে বিরোধও আছে। সব বিষয় আমলে নিয়ে তদন্তকারী সংস্থাগুলো কাজ করছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কেএনএফের সদস্য সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে হামলায় অংশ নেয়। তাদের ধরতে ইতিমধ্যে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চল নিরাপদ রাখার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তাই করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলায় বেশি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ওইসব এলাকায় কেএনএফের হিটার গ্রুপের সদস্যদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। সদস্যদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গাও আছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। রাঙ্গামাটির সাজেক, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবান উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা, আলীকদমসহ ৯টি উপজেলায় কেএনএফের অস্তিত্ব রয়েছে।
গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে, ২০১৬ সালে কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়। শুরুতে এর নাম ছিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। পরে কেএনএফ গঠন করা হয়। ভারতের মণিপুর ও মিয়ানমারের চীন রাজ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তারা সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম ব্যাচে শতাধিক সদস্যকে মণিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠায়। তা ছাড়া মিয়ানমারের কারেন ও কাচিন রাজ্যেও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
পুলিশ ও র্যাবের দুই কর্মকর্তা বলেন, কেএনএফের হিটার গ্রুপগুলোকে তারা টার্গেট করেছে। ব্যাংকে হামলা, আনসারদের অস্ত্র লুট, থানা ও বাজারে হামলার ঘটনায় সিসি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হামলায় অংশ নেওয়া কেএনএফ সদস্যদের প্রত্যেকের কাছে ভারী অস্ত্র ছিল। তারা উর্দি পরা ছিল। তবে কয়েকজনের গায়ে সাধারণ পোশাক ছিল। সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। হামলাকারীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশের বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে।