Hot

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ধার মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ চাপ ভোক্তার ওপর

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো মাত্রাতিরিক্ত ধার করায় বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা অর্থের স্থিতি কমছে। এতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ধারের বিপরীতে বাড়তি সুদ দেওয়ার কারণে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার চিত্র যেমন ফুটে উঠছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। বাড়ছে ঋণের সুদহার। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার দায় গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ওপর। এদিকে ব্যাংকের খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিট মুনাফা কম হচ্ছে। ফলে শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি আইএমএফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার মান আরও উন্নত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম প্রতিবেদন তৈরির শর্ত আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা দেওয়ার মাত্রা কমানোর কথা বলা হয়েছে। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যেই রেপো সুবিধা প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে ২ দিন দিচ্ছে। তবে অন্যান্য তারল্য সুবিধা প্রতিদিনই দেওয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর  ধারের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি কলমানি মার্কেট এবং এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে স্বল্প ও মেয়াদি ধারও করছে। তবে আন্তঃব্যাংকের মাধ্যমে ধারের প্রবণতা কমলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে সরকারি খাতের বিভিন্ন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থের একটি অংশ বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে দেখানো হয়। বাকি অংশ অতিরিক্ত বিনিয়োগ হিসাবে থাকে। এসব বিল ও বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে বিভিন্ন মেয়াদি ধার নিতে পারে। এর মধ্যে ১ দিন থেকে ১৫ দিন মেয়াদি ধার রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওইসব অর্থ পরিশোধ করে আবার ধার নিতে পারে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোকে বিশেষ আমানত ও ঋণ সুবিধার আওতায়ও ধার দিয়ে থাকে।

বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর ডিসেম্বর ও জুনের মধ্যে বিভিন্ন খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়। এ কারণে ওই ২ মাসের শেষ দিনে তারল্যের ছড়াছড়ি থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, কলমানিতে ধার দেওয়ার গ্রাহকও মেলে না। সুদের হার ১ শতাংশের কম থেকে ২ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে। কিন্তু এবার জুনের শেষ দিনেও কলমানির সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১০ শতাংশ। লেনদেন হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। জুনের শেষ ২ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করেছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণে এ ধার করেছিল। জুলাইয়ের প্রথম দিকে ধারের প্রবণতা কমলেও গত সপ্তাহে তা আবার বেড়ে যায়। রোববার ও সোমবার এই ২ দিনে ধার করেছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ১ দিনেই ৩২ হাজার কোটি টাকা ধার করার নজিরও রয়েছে।

এসব ধারের বিপরীতে সুদের হারও বেড়ে যাচ্ছে। কলমানির সুদ দীর্ঘদিন সর্বোচ্চ ৮ থেকে ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। এখন তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে উঠেছে। এর নিচে নামছে না। স্বল্প ও মেয়াদি ধারের সুদ হার ১১ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশে ওঠানামা করছে। রেপো সুদের হারও বেড়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে উঠেছে।

চড়া সুদে ধার করার ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাড়াতে হচ্ছে ঋণের সুদহার। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে পণ্য ও সেবার দাম। ফলে বাধ্য হয়ে ক্রেতাকে চড়া দামে পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। এর চাপ পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। এতে একদিকে বেশি দামে পণ্য ও সেবা কিনে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কারণে ভোক্তার আয় কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ দুভাবেই ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ তহবিল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো চড়া সুদে ধার করছে। কয়েক ধাপ ঘুরে এর দায় পড়ছে ভোক্তার ওপর।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের প্রতিটি শাখারই আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের বছরভিত্তিক একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে। ৬ মাস পরপর তা সংশোধন করা হয়। ওই সময়ে আমানত কমলেও ঋণ বিতরণও কমে যায়। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন পরিকল্পনার বাইরে কোনো খাতে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দিতে হয় তখনই ব্যাংক সংকটে পড়ে। পরিকল্পনার বাইরে তখনই ঋণ যাচ্ছে, যখন জালিয়াতি হচ্ছে। জালিয়াতির তো আর পরিকল্পনা হয় না। ফলে জালিয়াতি না করলে কোনো ব্যাংকেরই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। জালিয়াতির মাধ্যমে বেশি ঋণ বিতরণের ফলে সেগুলো আদায় হয় না, খেলাপি হয়। এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট বাড়ে। জালিয়াতি বন্ধ করলে তারল্য সংকট থাকবে না। জালিয়াতি বন্ধ করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংক খাতে এখন সুশাসনের বড় অভাব।

সূত্র জানায়, তহবিল ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়ালেও জাল জালিয়াতি যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হচ্ছে না। জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের শতভাগই খেলাপি হচ্ছে। ফলে ব্যাংক সংকটে পড়ছে। বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির এক যুগ অতিক্রম হলেও এখনও বড় জালিয়াতদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। হলমার্ক জালিয়াতিতে গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও যারা এটাকে আইনের তোয়াক্কা না করে উৎসাহিত করেছেন তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। আরও বড় জালিয়াতদের বিরুদ্ধেও কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কাঠামো করলেও তাদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে। ফলে এটি কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে সমপরিমাণ প্রভিশন রাখা আছে। ফলে এই দুই খাতে আটকে আছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রয়েছে ৮২ হাজার কোটি টাকা। এগুলো আটকে রয়েছে। এসব মিলে আটকে থাকা তহবিলের পরিমাণ ৫ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি রোধ করতে পারলে ওই পরিমাণ অর্থ ধীরে ধীরে বাজারে আসতে পারবে। ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকটও কমবে।

টাকার সংকটের কারণে বৃহস্পতিবারও ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো কলমানি মার্কেট থেকে ধার করেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করেছে ১২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা কলমানি মার্কেট থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ ধার করা একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধারের মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ধারের প্রবণতাও বেড়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button