Bangladesh

কেন গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে সীমায়িত করা যায় না

বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ২০২৪ সালে ৭৮টি দেশের নির্বাচনে অংশ নেবেন। বৈশ্বিক মিডিয়ায় বছরটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নির্বাচনের বছর’। একটি বছরের পরিসরে এতোগুলো নির্বাচন আর এতো ভোটারের উপস্থিতি আগে আর দেখে নি বিশ্ববাসী। তবে, ‘নির্বাচনের বছর’ বললেও কেউ কিন্তু বছরটিকে ‘গণতন্ত্রের বছর’ বলছেন না। কারণ, গণতন্ত্রকে কেবলমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সীমায়িত করা যায় না। কেন? প্রধান কারণ হলো, ভোটার যত জন, তার সামান্যই ভোট দেন বা দেওয়ার সুযোগ ও পরিবেশ পান। ফলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হয়ে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। নির্বাচনে নতুন সরকার আসে বটে, কিন্তু তা জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায় না।

নির্বাচনী ব্যবস্থাতেও রয়েছে একাধিক শুভঙ্করের ফাঁকি। ভোটারদের ক্ষমতায়ন হয় নি বহু দেশে। স্বাধীন ও ভয়হীন ভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা ও অধিকারের অনেক দেশের মানুষের নেই।

কালো টাকা, সন্ত্রাস ও প্রশাসনের চাপের কাছেও জিম্মি থাকতে হয় ভোটারদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটের ছক এমনভাবে করা হয় যে, ক্ষমতাসীনদের ভোটের মাধ্যমে টলানো যায় না। বরং ক্ষমতায় আসীনরাই ভোটকে তাদের ক্ষমতায় বহাল থাকার পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে সীমায়িত করতে বিশেষজ্ঞরা নারাজ। রাজনীতি বিজ্ঞানের পণ্ডিতগণ এই বলে সংশয় প্রকাশ করছেন যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো কি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারবে?  গণতন্ত্র কি আলোচিত-সমালোচিত নির্বাচনী ব্যবস্থার কঠিন পরীক্ষায় শুদ্ধতম রূপে টিকে থাকবে? নাকি নানা দেশের স্বৈরাচারী সরকারকে সাজানো ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে?

একটি প্রচলিত ভ্রান্তি হলো, অনেকেই মনে করেন, গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভোটের দিন বা নির্বাচন অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই বলে শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষকথা নয়। গণতন্ত্রের পরিধি অনেক বিস্তৃত, ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের পথে প্রধান সোপান। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে গণতন্ত্রের পথ মসৃণ হয় আর নির্বাচন বিতর্কিত, অগ্রহণযোগ্য ও দূষিত হলে গণতন্ত্রের পথ বিঘ্নিত ও বিপদগ্রস্ত হয়। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একদিনের নির্বাচনের পাশাপাশি  গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণশক্তি নিহিত থাকে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা চর্চার মধ্যে। দুঃখজনক ভাবে বর্তমান বিশ্বের বহু নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক দেশ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির স্বীকৃতি ও চর্চা নেই। যা আছে তা হলো, গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদ।

গণতন্ত্রের নাম ধারণ করে কর্তৃত্ববাদ বহাল থাকলে খোদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রচণ্ড ঝুঁকি কবলিত হয়।  রাষ্ট্র ও সমাজে, এমনকি মানুষের মধ্যে অগণতান্ত্রিকতার প্রকাশ ঘটে। গণতন্ত্রকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে তখন আসলে ‘কর্তৃত্ববাদ’ই কঠোর শাসন চালায়। বর্তমান বিশ্বের অসংখ্য দেশে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করলেও কাজেকর্মে কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে। এক্ষেত্রে এককভাবে নির্বাচন নিজস্ব শক্তিতে গণতন্ত্রকে কর্তৃত্ববাদের কবল মুক্ত করতে পারে না। এর মূল কারণ হলো, মোট প্রদানকৃত ভোটের ৩০-৩৫ শতাংশ পেয়ে এগিয়ে থাকা দলই বিজয়ী হিসেবে সরকার গঠন করে। এই ভোটের সংখ্যাও আবার চরমভাবে বিতর্কিত তথা সর্বজনস্বীকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ফলে সাদা চোখেই দেখা যায় যে, শতকরা ৩০-৪০% ভোট পেয়ে যারা নিজেদের গণতান্ত্রিক, জনসমর্থিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দাবি করে ক্ষমতা কব্জা করছে, তাদের প্রতি ৬০-৭০% মানুষের আস্থা, ভরসা ও সমর্থনই নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাধারণত যে পরিমাণ ভোট পেয়ে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে তা মোট ভোটের এক-তৃতীয়াংশ থেকেও কম। ফলে প্রাপ্ত ভোটের সমীকরণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এরূপ বিজয়ীরা বৃহত্তম জনমতের প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘিষ্ঠ। হতাশাজনক ভাবে, অসম্পূর্ণ বা খণ্ডিত বা অংশবিশেষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েই নির্বাচনে বিজয়ীরা প্রকৃত সত্য চাপা দেয়। বাস্তব চিত্রকে তারা তাদের আপেক্ষিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোয়ারে ঢেকে দিতে সচেষ্ট হয়।

এসব কারণেই নির্বাচিত সরকারমাত্রই সংখ্যাগরিষ্ঠ বা গণতান্ত্রিক সরকার, তা না-ও হতে পারে। আবার নির্বাচন মানেই গণতন্ত্রের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে, এমনটিও সব সময় আশা করা যায় না। বর্তমান বিশ্বের নানা দেশের শাসন ব্যবস্থা ও নির্বাচন প্রকৃত প্রস্তাবে গণতান্ত্রিকতার বার্তা দিচ্ছে না। নির্বাচনের মাধ্যমে বহু দেশে অল্প ভোট পেয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব। তাদের দ্বারা সরকার গঠন করাও সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তারা প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। এদের দ্বারা গণতন্ত্রের বিকাশ ও সুরক্ষা অসম্ভব।  এদেরকে ভর করেই কর্তৃত্ববাদ জাঁকিয়ে বসে। এসব কারণে উদার, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বদলে নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হলে গণতন্ত্রের মারাত্মক বিপদ সৃষ্টি হয়। তাই গণতন্ত্রকে কেবলমাত্র নির্বাচনের নিরিখে বিবেচনা করা সমীচীন নয়। আর যে নির্বাচন প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ চয়নের ব্যর্থতার পাশাপাশি বিরোধীদল উপস্থাপনেও যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য সুখবর নয়। কারণ, গণতন্ত্রের দুটি পায়ের একটি সরকার হলে আরেকটি বিরোধীদল। একটি ছাড়া অন্যটি অচল ও অপূর্ণাঙ্গ।

দৃষ্টান্তস্বরূপ,  সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোটই বাস্তবে প্রদান করা হোক না কেন, একচোটিয়া ভাবে ক্ষমতাসীন  আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন। এতে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল দ্বিতীয় অবস্থানে নেই। দ্বিতীয় অবস্থান ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর করতলগত, যাদের মাত্র চারজন সত্যিই স্বতন্ত্র আর ৫৮ জন আওয়ামী লীগের পদাধিকারী।  

আলোচিত-সমালোচিত গত সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবার মাত্র ১১টি আসন পেয়েছে। এরাও আবার ভঙ্গুর। দলের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল চরমে। চলছে পারস্পরিক বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের উত্তেজনা। ফলে ৬২ জন স্বতন্ত্রের তুলনায় সংখ্যালঘু এবং দলীয় সংঘাতে জর্জরিত জাতীয় পার্টি এবারের জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে নাজুক ও কোণঠাসা। তাদের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে রয়েছে ঘোরতর অনিশ্চয়তা। এহেন প্রান্তিক বিরোধীদল, যাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা অনিশ্চয়তার কুয়াশায় আচ্ছন্ন, তারা বিরোধীদল হিসাবে গণতন্ত্রের জন্য আদৌ কোনো সুসংবাদ বহন করে না।

অতএব, গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। নির্বাচন মানে শুধু ভোট নয়। ভোটারের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রকৃৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও শক্তিশালী বিরোধীদল চয়নই আসল কথা, যারা কর্তৃত্ববাদের পথে নয়, চলবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আলোকে গণতান্ত্রিক ধারায়। তখনই গণতন্ত্রকে দেখা যাবে পরিপূর্ণ ও সফল অবয়বে। গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমায়িত করে গণতন্ত্রের বৃহত্তর পরিসর, টেকসই উপস্থিতি ও নির্ভেজাল ইমেজ তৈরি করা মোটেও সম্ভব নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d