Bangladesh

কেন দেশ ছাড়ছেন তরুণরা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি। এখন চাকরি করছি ১৮ হাজার টাকা বেতনে। যেখানে আমার লেখাপড়ার সময় মাসে গড়ে খরচ হয়েছে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কথাগুলো বলছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আতিক এহসান। তিনি বলেন, এতো টাকা খরচ করে বাবা-মা পড়ালেন। এখন নিজের খরচটাই চালাতে পারছি না। আমি সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে এই বিষয়ের গুরুত্ব আছে। এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যও বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম। তিনিও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। তিনি বলেন, দু’টা কারণে মূলত দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, অর্থনৈতিক আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজা বিনা কারণে জেল খাটলো। প্রতিদিন সকালে উঠেই একটা নিউজ চোখে পড়ছে অস্বাস্থ্যকর ঢাকার বায়ু। দ্রব্যমূল্য নিয়ে কী হচ্ছে তাতো সবার জানা। এতো নেতিবাচক প্রভাব পীড়া দেয়। আমার বাবার পেনশনের টাকা তুলতে আট মাস হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা ঘুষসহ খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। এসব কারণে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। 

নাজমুল বলেন, আমার বড় ভাই আট বছর চেষ্টা করেও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাননি। আবার উদ্যোক্তা হতে গিয়েও ধাপে ধাপে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এখন আমি দেশে এই রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। 
আতিক, নাজমুলের মতো হাজারো তরুণ এখন বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কেউ জমানো টাকা খরচ করে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার কেউ ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রত্যেকেই বলছেন অর্থনৈতিক ও উন্নত জীবনের কথা। দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ তরুণ-তরুণী। এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৪২ শতাংশই বিদেশে পাড়ি দিতে চান বলে এক সমীক্ষায় এসেছে। গত বছর বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’- শীর্ষক সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। এই সার্ভেতে বলা হয়, তারা জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এসব কারণে বিদেশে যেতে চান। 

জরিপে অংশ নেয়া ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী বিশ্বাস করেন বর্তমানে দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা নেই। অপরদিকে ৬৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন গত পাঁচ বছরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া ২৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী মনে করেন দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পাচ্ছে, যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাবাস্‌সুম বলেন, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমি এক্সট্রা অর্ডিনারি কোনো শিক্ষার্থী না। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাও দ্বিগুণ। নিরাপত্তাহীনতার কথাও মাথায় রাখতে হয়। এ কারণে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। 

শাহ্‌জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমি এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছি রংপুরে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় কলেজও যেতে পারতাম না। এখন ভার্সিটিতে এসেও একই সমস্যার মুখে পড়েছি। এখানে সবসময় ভীত থাকতে হয়। আমার রাজনীতি করার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছি। এখন অনার্স শেষ করেই দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবো। 
২০২২ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন। ২০২১ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ৪৪ হাজার ২৪৪ জন, ২০২০ সালে ৫০ হাজার ৭৮, ২০১৯ সালে ৫৭ হাজার ৯২০ এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ১৯১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশসমুহে। এরবাইরেও যাচ্ছেন রাশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ আরও অনেক দেশে। 

ইংল্যান্ডের মারিওনার্সি ইউনিভার্সিটিতে গত বছরের জুনে মাস্টার্স করতে যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স সম্পন্ন করা নিলয় মাহমুদ। তিনি বলেন, এখানে আমি একটা টিকিট কাউন্টারে কাজ করি। আমাকে আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ঘণ্টা হিসেবে অর্থ দেয়া হয়। এর বাইরে ওভারটাইমের সুযোগ আছে। ভালো অর্থ পাই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ৫০ শতাংশ ওয়েভারে পড়তে এসেছি। আমার সব খরচ ভালোভাবে মেটানোর পরও দেশে ৫০ হাজার টাকা করে নিয়মিত পাঠাই। এছাড়াও ঈদের সময়তো ৮০ হাজার টাকা পাঠালাম।

নিলয় বলেন, দেশের বাইরে জব সিকিউরিটি আছে। আমার দু’দিন সপ্তাহে ছুটি। সুযোগ থাকলে ডে অফের দিনেও কাজ করার সুযোগ আছে। মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর আমি অফিসিয়াল জবের জন্য আবেদন করবো। জবের জন্য আমাকে কারও রেফারেন্স বা ঘুষের প্রয়োজন পড়ছে না।

যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করে সেখানেই একটি সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সিতে কাজ করছেন সিদ্ধার্থ রায়। তিনি বলেন, উন্নত জীবনের জন্যই দেশ ছেড়ে এসেছি। আমি এখানে যে চাকরি করছি তাতে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা আয়। প্রতি মাসে ন্যূনতম ৪/৬ লাখ টাকা সেভিংস হচ্ছে। আমি একটা উন্নত ভবিষ্যতের চিন্তা করছি। আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে থাকি। স্ত্রী চাকরিতে যাচ্ছে কোনো ভয় ছাড়াই চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। 

জাপানে কিউশু ইউনিভার্সিটিতে তিন মাস হলো পিএইচডি করতে যাওয়া আফিয়া জান্নাত বলেন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষক হিসেবে চাকরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি সুপারিশের কাছে হেরে যাই। যাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি কোনো এক রাজনীতিবিদের ভাইয়ের ছেলে। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি হলো না। এখন জাপানে থাকার পরিকল্পনা করছি। কারণ দেশে আমার যোগ্যতা সুপারিশের কাছে হেরে গেছে।

তিনি আরও বলেন, নারীদের জন্য দেশে যুদ্ধটা আরও কঠিন। বাংলাদেশে একটা নারী ঘর সামলাবে, ছেলে-মেয়েকে দেখাশোনা করবে- এটাই যেন কাজ। একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন, বিশেষ করে ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোতে অধিকাংশ নারী গৃহিণীই কাজের জন্য লোক রাখছেন। কারণ পরিবেশটা চ্যালেঞ্জিং। বাচ্চাকে ১০ মিনিট চোখের আড়াল করা যাচ্ছে না। সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়, হারিয়ে যাওয়ার ভয়, ঘরের বাইরে গেলে ভয়। চারদিকে শুধু ভয় আর ভয়। আবার এই মা কিন্তু বাচ্চা হওয়ার আগে অন্যের সহযোগিতায় চলতেন। এই দু’টো ভয়ই যদি না থাকতো। সামাজিক সুরক্ষা বলয়টা জরুরি। বলয়টা থাকলে ঢাকার নারীটাও চাকরি করার পরও সংসারের কাজ করতে পারতেন অনায়াশেই। কিন্তু এখন গৃহিণী হওয়ার পরও ঘরের কাজ শেষ করতে পারছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে পড়ছে কাজ করছে এটা আমাদের জন্য গর্বের। আবার এসব মেধাবীকে কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি তাও ভাবতে হবে। মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তাদের যেন আমরা মূল্যায়ন করতে পারি। দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বিদেশে চলে যাচ্ছে এতে ক্ষতি হচ্ছে। আবার তারা দক্ষ হয়ে ফিরে এলে দেশের জন্য ভালো।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor