International

কেন পালাচ্ছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা?

মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে ওই দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে মিয়ানমারের বাহিনী। এতদিন এই যুদ্ধকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সে দেশের একের পর এক সীমান্তরক্ষী বা সেনা সদস্যর অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশেও।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যেকার তুমব্রু ঘুমধুম সীমান্তের তিনটি স্থান দিয়ে রোববার দুপুর থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি-র সদস্যরা।

রোববার দুপর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৮ জন প্রবেশের তথ্য দিয়েছে বিজিবি সদর দফতর। এমন অবস্থায় সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।

ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মূলত সীমান্তের তিনটি জায়গা থেকে মিয়ানমারের সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা তাদের প্রথমেই কর্ডন ও অস্ত্র আলাদা করেছি। এবং তাদেরকে আমরা নিরাপদ স্থানে রেখেছি।’

তাদেরকে দ্রুতই বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠাতে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

রোববার তিনি জানিয়েছেন, ‘তাদের যাতে দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায় সে জন্য ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের সাথে।’

কেন পালাচ্ছে সীমান্তরক্ষীরা?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সে দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে কয়েক মাস থেকে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলেও খবর আসছে।

থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমার নাগরিকদের পরিচালিত সংবাদ মাধ্যম ‘ইরাবতী’ রবিবার যে সংবাদ প্রচার করেছে সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির আরেকটি ব্যাটেলিয়ন দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা।

আরাকান আর্মির বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম ইরাবতী জানাচ্ছে, গত বুধবার রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় রামরি এলাকায় জান্তা বাহিনীর সাথে তাদের লড়াই হয়। বঙ্গোপসাগরের ওই দ্বীপ শহরে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা ঢোকার পর সেখানে জান্তা বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈনিকদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন তারা।

সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, আরাকান আর্মি ১৩ নভেম্বর রাখাইনে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করার পর সিতওয়ে-র নিকটবর্তী পাউকতাও শহর এবং চিন প্রদেশের পালেতাওয়া শহর-সহ ১৬০টি অবস্থান থেকে মিয়ানমার বাহিনীকে উৎখাত করেছে।

এই ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যেও যুদ্ধ-পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

দু’পক্ষের সংঘাত এতটাই তীব্র আকার নেয় যে রোববার দুপুর থেকে মিয়ানমারের বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে।

ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানেরর অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনটি স্থান থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এবং সেটি এখনো অব্যাহত রয়েছে, ফলে এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

সীমান্ত পরিস্থিতি এখন কেমন?
রবিবার মধ্য শেষ রাত থেকে গোলাগুলি শুরু হয় ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে। ভোররাত থেকে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

ওপারে গুলি ও মর্টার শেলের শব্দে কেঁপে ওঠে সীমান্তের বাংলাদেশ অংশও।

স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাই বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘রোববার সকাল থেকে আমি তুমব্রুর পশ্চিমকূল মসজিদের পাশে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে একজনকে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকতে দেখলাম।’

তিনি বলেন, ‘তার হাতে অস্ত্র ছিল, তবে গায়ে সামরিক পোশাক ছিল না। কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে সীমান্ত-রক্ষী বাহিনীর সদস্য।’

ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর পাহারা দেখা যায় স্পষ্টভাবে। এই অংশে ছোট বড় তিনটি ক্যাম্প রয়েছে সে দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর। গত শনিবার পর্যন্ত সেগুলো জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

গণমাধ্যমকর্মী আজিম নিহাই বিবিসি বাংলাকে জানান, রোববার সকাল থেকে দেখা যায় ৩৪ পিলার রাইট ক্যাম্পটি দখলে নিয়ে নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। এটি দখলের পর আরাকান আর্মি ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্পের দিকে রওনা দিয়েছে, তা এপার থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

গোলাগুলির সময় কিছুক্ষণ পরপর মিয়ানমার সীমান্তে হেলিকপ্টারের মহড়া দেখা যাচ্ছে। যেগুলো ব্যবহার করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

এই গোলাগুলির মধ্যেই কিছুক্ষণ পরপর দু এক জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পালিয়ে আসছে বাংলাদেশ অংশে।

ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানেরর অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের স্থানীয় বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্য স্থান ত্যাগের কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় যে সকল ব্যবস্থা রয়েছে, সীমান্ত রক্ষার জন্য তা জোরদার করেছি।

সীমান্তে স্কুল বন্ধ, আতঙ্কিত লোকজন
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চললেও তা এপাড়ে এসেও পড়ছে। এ ঘটনায় রোববার সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে একজন গুলিবিদ্ধ ও আরেকজন আহত হয়েছে।

এমন অবস্থায় পুরো সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন অনেকে।

শনিবার রাতে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া একটি মর্টার শেল এসে পড়ে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার ইউনুছ ওরফে ভুলুর বাড়িতে। বাড়ির টিন ছিদ্র হয়ে মর্টার শেলটি ঘরের ভিতরে এসে পড়ে। তবে সে সময়ে পরিবারের সদস্যরা কেউ বাড়ি না থাকায় হতাহত হননি কেউই।

এমন অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের কাছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এক দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বন্ধ হওয়া স্কুলগুলো হলো বাইশপারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজু গর্জন বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এগুলো সোমবারও বন্ধ রাখার কথা বিবিসিকে জানিয়েছেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া।

বিবিসি বাংলাকে জাকারিয়া বলেন, ‘আরো তিনটা স্কুল স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। অবস্থা খারাপ হলে সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে। সেই সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার একটি কেন্দ্র সরানোর জন্য কাজ চলছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে কেন্দ্রও সরানো হবে।’

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সতর্ক করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজক। বিজিবি তার শক্তি জোরদার করেছে। সীমান্ত বরাবর তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পারে।’

চীনের হস্তক্ষেপ চায় বাংলাদেশ
মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার কথা বলছে বাংলাদেশ।

রোববার সচিবালয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মিয়ানমারে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার আঁচ বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘এর ফলে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে চীনের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছে চীন।’

ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘যুদ্ধটা তাদের অভ্যন্তরীণ। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির আওয়াজ আমাদের এখানে যখন চলে আসে, স্বাভাবিক কারণে ভয়ভীতিও আসতে পারে। এজন্য চীনের হস্তক্ষেপ চেয়েছি।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d