কেন মনোনয়ন পাননি জনপ্রিয় আহমাদিনেজাদ
- ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন
- মেয়র থাকাকালে নিজ হাতে তেহরানের রাস্তা ঝাড়ু দিতেন
- প্রেসিডেন্ট ভবনের মেঝেতে কার্পেটের ওপর ঘুমাতেন
সৎ, সাহসী, পরিশ্রমী ও দূরদর্শী এবং জনপ্রিয় নেতা হিসেবে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ সমাদৃত। তিনি ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট পদে আগামী ২৮ জুন নির্বাচন হবে। সেখানে প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে ছয় প্রার্থীকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে ইরানের সাবেক কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রার্থিতার আবেদন করলেও তাকে মনোনয়ন দেয়নি দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিল।
গত ২ জুন প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধনের কথা জানান আহমাদিনেজাদ। তবে বিশ্লেষকরা সে সময় মত দিয়েছিলেন, গার্ডিয়ান কাউন্সিল খুব সম্ভবত তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। এর আগে ২০১৭ ও ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি প্রার্থিতার আবেদন করেও অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। এবারও তাকে একই ভাগ্য বরণ করতে হলো। কারণ খামেনির উত্তরসূরি এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে সাংবিধানিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’ কর্তৃক অনুমোদন পেতে হয়।
ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডস সেনাদলের সাবেক সদস্য আহমাদিনেজাদ প্রথম ২০০৫ আলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে মেয়াদ পূর্তির পর পদ ছেড়ে দেন। ইরানের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খামেনির একছত্র আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আহমাদিনেজাদ। এরপর থেকেই খামেনির সঙ্গে তার সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়।
২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। সে সময় আহমাদিনেজাদের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠে। ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডস কর্পসের নেতৃত্বে সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সে সময়য় এই রক্তাক্ত দমন-পীড়ন অভিযানে অসংখ্য মানুষ নিহত হন ও হাজারো বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৬ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তাকে সতর্ক করে বলেন, তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ ‘দেশের স্বার্থপরিপন্থী’। এরপর ২০১৭ সালে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়নি গার্ডিয়ান কাউন্সিল। ২০১৮ সালে আহমাদিনেজাদ খামেনির সরাসরি সমালোচনা করেন, যা ইরানে খুবই বিরল। তিনি তাকে চিঠি পাঠিয়ে ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ আয়োজনের আহ্বান জানান।
আহমাদিনেজাদ ১৯৫৬ সালের ২৮ অক্টোবর তেহরানের পাশে গার্মসার নামে একটি শহরের প্রত্যন্ত গ্রামে ও খুব গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন কামার। আহমাদিনেজাদ ১৯৭০ সালের শেষের দিকে ‘সারকর্ড’ শহরের মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি আর্মিতে যোগদান করেন। এর পর তিনি তুর্কি বর্ডারের কাছে ‘মাকু’ শহরের মেয়র পদে নিযুক্ত হন।
১৯৯০-এর শেষের দিকে তিনি ‘আরদাবিল’ শহরের গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। পরে তিনি হার্ডলাইন রেভুলেশনারি গার্ডের বিশেষ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৩ সালে আহমাদিনেজাদ তেহরানের মেয়র পদে নির্বাচিত হন। মেয়র থাকাকালে তিনি নিজ হাতে তেহরানের রাস্তা ঝাড়ু দিতেন।
দুই বছর তেহরানের মেয়র থাকার পর ২০০৫ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তিনি তার অফিসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। প্রেসিডেন্ট ভবনের দরজা-জানালা খুলে দেওয়া হয় সাধারণের জন্য। প্রেসিডেন্ট অফিসে সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ ইরানিদের চিঠি গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তার জীবনযাপন যেমন ছিল পরেও ঠিক তেমনটিই ছিল। আভিজাত্য তাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তেহরানের বস্তিতে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ি, যা ৪০ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান হয়েও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কোনো টাকা নিতেন না। তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া বেতনের টাকা দিয়েই সংসার চালাতেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিলাসবহুল এক বাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেই বাড়িকে তুচ্ছজ্ঞান করে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বস্তির সেই দুই রুমের ছোট্ট বাড়িতেই বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সরকারের কর্মকর্তাদের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে বসবাস করতেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই প্রেসিডেন্ট ভবনের দামি কার্পেটগুলো তেহরানের মসজিদে দান করে দেন। এর পরিবর্তে সাধারণ মানের কার্পেট বিছানো হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। আর সেই প্রেসিডেন্ট ভবনের মেঝেতে সেই সাধারণ মানের কার্পেটের ওপরই ঘুমাতেন তিনি। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ভবনের ভিআইপি অতিথিশালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটি সাধারণ ঘরেই ভিআইপিদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা রাখা হয়।
৩ আগস্ট ২০১৩ ইরানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেও ইতিহাস তৈরি করে যান আহমাদিনেজাদ। ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ সাদেক লারিজানির কাছে লেখা এক চিঠিতে আট বছরে অর্জিত সম্পদের হিসাব দিয়ে যান তিনি। যে হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সম্পদে যে পরিবর্তন এসেছে, তা হলো— তিনি তার পুরোনো বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। তবে বাড়িটি পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট দপ্তরের ফান্ড থেকে ঋণ নেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তরের ফান্ড ও ব্যাংক থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য অসংখ্য মানুষ ঋণ নিয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্টও সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে সেই ঋণ নিয়েছেন।
ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো ধরনের প্রভাব খাটাননি। একই সঙ্গে বাড়ি পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরাও সহযোগিতা করেছেন। পুনর্নির্মিত দোতলা ভবনে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ওই ভবনেই তিনি ও তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটার আয়তন মাত্র ১৭৫ বর্গমিটার। জমিটুকু বাবার কাছ থেকে পাওয়া।
প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় ছেলের বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিলেন মাত্র ৪৫ জন (২৫ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ) অতিথিকে । শুধু কমলা, আপেল, কলা ও ছোট এক টুকরো কেক দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এনবিসি নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি অত্যন্ত হাসিমুখে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন— এর চাইতে বেশি মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষে তিনি তার আসল পেশা শিক্ষকতায় ফিরে যান।