কেন সমুদ্রের উষ্ণতা বাড়ার রেকর্ড? এটা জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়েও বেশি কিছু?
মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট রিঅ্যানালাইজার অনুসারে, ১৯৮২-২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি। এটি একটি বিশাল অসংগতি যা আবহাওয়া এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট রিঅ্যানালাইজার অনুসারে, ১৯৮২-২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি। এটি একটি বিশাল অসংগতি যা আবহাওয়া এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন সমুদ্রের তাপমাত্রার রেকর্ড হচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এ নিয়ে ক্রমশ উদ্বেগ বাড়ছে সমুদ্র বিজ্ঞানীদের।
শুধু সমুদ্র নয়, পুরো পৃথিবী কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত হয়ে আছে।
নাসা গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গেভিন স্মিড বলেন, ‘এই বিষয়টি যে উদ্বেগপূর্ণ তা নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই।’
ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামি রোজেনস্টিয়েল স্কুল অব মেরিন, অ্যাটমোসফেরিক অ্যান্ড আর্থ সায়েন্সের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ব্রায়ান ম্যাকনল্ডি বলেন, ‘এটি শুধু সমুদ্রের রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রার পুরো একটি বছর নয়, এটি আগের সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এজন্য অনেকের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।’
মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট রিঅ্যানালাইজার অনুসারে, ১৯৮২-২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি। এটি একটি বিশাল অসংগতি, যা আবহাওয়া এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
এই তাপমাত্রার রেকর্ডের পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করছে বিজ্ঞানীরা। তা জানতে পারলে তাদের জলবায়ু মডেলগুলো উন্নত করতে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে তাপমাত্রার পূর্বাভাস দিতে তাদের সহায়তা করবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত মাসে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ছিল ২১ দশমিক ০৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৬৯ দশমিক ৯৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
কোপার্নিকাসের ডেপুটি ডিরেক্টর সামান্থা বার্গেস চলতি সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘২০২৪ সালের মার্চ মাসে ধারাবাহিকভাবে বাতাসের তাপমাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা উভয়ই জলবায়ু রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।’
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ক্রান্তীয় আটলান্টিক অস্বাভাবিক উষ্ণ, যা দ্রুত হারিকেন সংগঠনের মতো পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়তা করছে। কারণ সমুদ্রের উচ্চ তাপমাত্রা শক্তিশালী ঝড়ের শক্তি আরও বাড়ায়।
দীর্ঘদিন ধরেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কোনোভাবেই কমছে না। ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে পৃথিবীর উষ্ণতাও বাড়ছে।
এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প গড় তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে। বাতাসের চেয়ে পানি উত্তপ্ত হতে বেশি তাপ লাগে। মহাসাগরগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস থেকে পৃথিবীর বেশিরভাগ তাপ শোষণ করেছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বেশি থাকবে, ততক্ষণ মহাসাগরগুলো শক্তি শোষণ করতে থাকবে। এতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা চলতেই থাকবে।
গবেষকরা বলছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন সম্ভবত একটি ভূমিকা পালন করছে, তবে সম্ভবত এটিই একমাত্র কারণ নয়। জলবায়ু মডেলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অবিচ্ছিন্ন বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়, তবে এত দ্রুত নয়। এছাড়া সমুদ্রের পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও ওঠানামা করে এবং এল নিনো ও লা নিনার মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
তাই বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে জানেন না কেন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এত বেশি বেড়েছে।
স্মিড বলেন, কিন্তু গত বছর যে ‘বিশাল, বিশাল রেকর্ড’ তৈরি হয়েছে, তা জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও বেশি।
গত বছরের জুলাই মাসে শুরু হওয়া একটি এল নিনোর প্রভাবে কাবু হয়েছে পড়েছে পৃথিবীবাসী। আবহাওয়ার স্বাভাবিক গতির পরিবর্তনের ফলেই এল নিনো হয়।
তিনি বলেন, এল নিনো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং শিগগিরই বিলীন হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনো ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ তাপমাত্রার রেকর্ডে প্রভাব ফেলতে পারে।
এর একটি কারণ হলো অ্যারোসল দূষণ। ২০২০ সালে কার্যকর হওয়া নতুন আন্তর্জাতিক জ্বালানি মানদণ্ড অনুসরণ করে, মহাসাগর অতিক্রমকারী কনটেইনার জাহাজ থেকে অ্যারোসল দূষণ হ্রাস করা যেতে পারে। অ্যারোসল মূলত বায়ুমণ্ডলে শীতল প্রভাব ফেলে এবং এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যিকারের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
আরেকটি কারণ হলো, ২০২২ সালে পানির নিচের হুঙ্গা টোঙ্গা-হুঙ্গা হা’পাই আগ্নেয়গিরির বিশাল অগ্ন্যুৎপাত।
মাটিতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে কাদা ও অ্যারোসলের প্লাম ছড়িয়ে পরে, যা সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা দেয় এবং অস্থায়ীভাবে বায়ুমণ্ডলকে শীতল করে।
কিন্তু এই আগ্নেয়গিরিটি প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে ডুবে যাওয়ায় এর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশে লাখ লাখ টন জলীয় বাষ্পও ছড়িয়ে পড়ে। জলীয় বাষ্প একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস।
ইউনিভার্সিটি অব মেইন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শন বার্কেল বলেন, ‘ক্রাকাতাউয়ের পর এটিই সবচেয়ে বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত।’
তিনি বলেন, আগ্নেয়গিরিটির এই অগ্ন্যুৎপাতের উষ্ণায়নের প্রভাব প্রাথমিক অনুমানের চেয়েও বেশি ছিল। বোঝা যাচ্ছে এই অগ্ন্যুৎপাত বায়ুমণ্ডলীয় সঞ্চালনকে প্রভাবিত করেছে এবং ২০২৩ সালে হওয়া এল নিনোকে দীর্ঘতর করেছে।
তবে এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সেন্ট থমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন আব্রাহাম বলেন, আমি আশঙ্কা করছি যে কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটছে, আমরা তা হয়ত এখনো শনাক্ত করতে পারিনি।
কারণ যাই হোক না কেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা ভয়াবহ হুমকি ডেকে আনতে পারে।
আব্রাহাম বলেন, উষ্ণ পানি ঝড়কে আরও শক্তি সরবরাহ করে। তাই এ সময় যেসব হারিকেন তৈরি হয়, সেগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, উষ্ণ পানি দ্রুত তীব্রতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে এবং হারিকেন বাতাস উপকূলের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে হঠাৎ তীব্রতর হয়ে ওঠে। যেমন: গত বছর হারিকেন ইদালিয়া ২৪ ঘণ্টায় ক্যাটাগরি ১ থেকে ক্যাটাগরি ৪-এ চলে গিয়েছিল।
ম্যাকনল্ডি বলেন, অতিরিক্ত সামুদ্রিক উষ্ণতা ঝড়ের মৌসুমকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।
আব্রাহাম বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা উপকূলীয় অঞবচলে ভারী বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে এবং বায়ুমণ্ডলকে আর্দ্র ও গরম করে তুলেতে পারে।
ম্যাকনল্ডি বলেন, তিনি প্রবাল নিয়েও উদ্বিগ্ন, গত বছর এগুলোর অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত বছর উষ্ণ পানির ফলে ফ্লোরিডা ও ক্যারিবিয়ান সাগরে ভয়াবহ ব্লিচিং ঘটেছিল। প্রবালগুলো সাদা হয়ে যায় এবং তাদের টিস্যুতে বসবাসকারী সালোকসংশ্লেষী শেত্তলাগুলো উঠে যায়।
ম্যাকনল্ডি বলেন, ‘আমরা এখন যে অসঙ্গতি দেখছি তা যদি আগামী মাসগুলোতে অব্যাহত থাকে, তবে মহাসাগরগুলো ২০২৩ সালের চেয়েও উষ্ণ হয়ে পড়বে এবং আমরা আরও খারাপ প্রবাল ব্লিচিংয়ের ঘটনা দেখতে পাবো।