কোটিপতিদের আয়ের হিসাবে ফকিরেরা ‘বড়লোক’, সরকারের খাতায় মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে
সরকারের খাতায় মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গত অর্থবছর যা ছিল ২৭৪৯ ডলার। সেটা বেড়ে চলতি অর্থবছর মাথাপিছু আয় হয়েছে ২৭৮৪ ডলার। আসলেই কি মাথা পিছু আয় বেড়েছে? গবেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফিতি আর মুদ্রস্ফিতিতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। মানুষ বাধ্য হয়ে খাবার কমিয়ে দিয়েছে। মানুষ কাজ হারাচ্ছে এবং বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তারপরও সরকারি খাতায় মাথাপিছু আয় বাড়ছে দেখানো হয়েছে। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক মাসে বেতন পায় ১২৫০০ টাকা। ডলারের হিসেবে তা দাঁড়ায় ১২০ ডলার। বছরে আয় ১৪৪০ ডলার। ফকির-মিসকিনদের আয় আরো কম। অথচ এমনো ব্যাক্তি রয়েছেন যিতি প্রতিদিন পকেট খরচ করেন ১৪৪০ ডলার। দুই হিসেবে মিলিয়ে গড় মাথাপিছু আয় দেখানো হচ্ছে। এটা যেন কোটিপতিদের আয়ের হিসেবে ফকির-মিসকিনরা বড়লোক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মাথাপিছু আয়ের এই হিসাব শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ডলারের আগের দাম দেখানো হতে পারে। আবার বর্তমানে টাকার অঙ্কে কনভার্ট করলে বেড়ে যাবে। এটা শুভংকরের ফাঁকি। যেটা দেখানো হচ্ছে এটা প্রকৃত আয় নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের আয় বাড়েনি, মজুরিও বাড়েনি। ফলে হিসাবটা মিলছে না। দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে। কোটিপতিদের আয়ের হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৭৮৪ ডলার হয়েছে। গত অর্থবছর যা ছিল ২ হাজার ৭৪৯ ডলার। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩৫ ডলার। বর্তমানে টাকার হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩ লাখ ৬ হাজার ১৪৪ টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা। ফলে এই প্রথম তিন লাখ টাকা ছাড়ালো মাথাপিছু আয়। যদিও ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র সোয়া ১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সোমবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে। যদিও এটি চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাব।
গত এক বছরে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি সেভাবে বাড়েনি। এ সময়ে দেশে কোটিপতিদের আয় বাড়লেও গরিবদের আয় বাড়েনি সেভাবে। তবে বিবিএস মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যে তথ্য দিয়েছে, এতে কোটিপতিদের আয়ের হিসাব গরিবের সঙ্গে যোগ হয়েছে।
গত দেড় দুই বছর ধরে ডলারের দাম বেশ বেড়েছে। ৮৬ টাকার ডলারের দাম উঠেছে ১১৭ টাকায়। এখন ব্যাংকে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। ফলে মাথাপিছু আয়ে এর প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৩৫ ডলার বেড়েছে। ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র সোয়া ১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছর মাথাপিছু আয়ের হিসাবে প্রতি ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৯৭ পয়সা ধরেছে বিবিএস। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। ফলে অর্থবছর শেষে চ‚ড়ান্ত হিসাবে ডলারে মাথাপিছু আয় আরও কমতে পারে। তবে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু আয় এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ শতাংশের মতো। অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ১৪৪ টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় যা ৩২ হাজার ৭৮৪ টাকা বেশি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়লেও আমরা এর সুফল ঠিকভাবে ভোগ করতে পারছি না। কারণ দেশে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। আমরা ১০০ ডলার দিয়ে যেসব জিনিসপত্র কিনতে পারবো ভারতে আরো বেশিকিছু কেনা যাবে। আমাদের এখানে সবকিছুর দাম বেশি। ফলে মাথাপিছু আয় বাড়লেও সেভাবে সুবিধা বাড়েনি। মাথাপিছু আয় কিন্তু প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতার নিচে।
মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরে আয়ের পাশাপাশি প্রবাসী আয়সহ যত আয় হয়, তা একটি দেশের মোট জাতীয় আয়। মোট জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়। করোনা মহামারির পর থেকে ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয়ে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় হয়। ওই অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। পরের বছর তা কমে ২ হাজার ৭৪৯ ডলারে নামে। এ বছর আবার তা বেড়ে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। তিন বছর ধরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭০০ ডলারের ঘরে আছে।
সরকারি হিসেবে দেখা যায়, গত ১০ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১৩১৬ ডলার। পরের ৮ বছর একটানা মাথাপিছু আয় বেড়েছে।