কোথাও উন্নতি কোথাও অবনতি: বন্যা পরিস্থিতি
সিলেটসহ সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি আবার কোথাও অবনতি হয়েছে। কিছু কিছু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিছু এলাকার পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছেন মানুষ। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় তিস্তাপাড়ের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কমেছে সুরমার সিলেট পয়েন্টের পানি। যার ফলে সাত দিন পর বিপৎসীমার নিচে নেমেছে এই পয়েন্টের পানি। তবে এখনো বিপৎসীমার ওপরে কুশিয়ারার সবকটি পয়েন্টের পানি। কুশিয়ারায় পানি বাড়ায় জেলার জকিগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, দক্ষিণ সুরমা, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবেছে রাস্তাঘাট। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে পানির নিচে। গত বুধবার রাতে জকিগঞ্জ পৌরসভার নরসিংপুর এলাকা দিয়ে ডাইক ভেঙে কুশিয়ারা নদীর পানি জনপদে প্রবেশ শুরু করে। ফলে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা গত বৃহস্পতিবার প্লাবিত হয়। গতকালও প্লাবিত এলাকার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া সুরমায় পানি কমায় গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব উপজেলায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা কেউ কেউ বাড়ি ফিরছেন। সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলার ১৩ উপজেলায় ১০১টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ১ হাজার ১৮০টি গ্রামের ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৫০টি আশ্রয় কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৩২৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর জানান, বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে রংপুরে তিস্তার পানি বাড়ছে। পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরগুলো প্লাবিত হয়েছে। জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে তিস্তার তীব্র স্রোতে নদী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে গঙ্গাচড়া উপজেলায় কমপক্ষে ৪০টি বসতভিটা নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা, ধরলা, ব্রক্ষপুত্র, যমুনা নদীর ১২টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জানা গেছে, গত রবিবার রাত থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দের পূর্ব বিনবিনা, লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের ইচলির চর, শংকরদহচর, বাগেরহাট ও নোহালী চর, মর্নেয়ার তালপট্টি, নরসিং, গজঘণ্টার গাওছোয়া, আলালচর, ছালাপাক চরে প্রায় ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এসব পরিবার গবাদি পশু ও বাড়ির জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়। নিজেদের খাবার সমস্যা থাকলেও গবাদি পশুর খাবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার নদীতীর, চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনা নদীর পানি আরও বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে বড় ধরনের বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোতে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, যমুনাসহ নদনদীর পানি বাড়লেও বন্যা পরিস্থিতির এখনো অবনতি হয়নি। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি উপজেলায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৮৮ সেমি ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৮ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে করতোয়া নদীর পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। ফলে এসব নদনদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার পরিবার। তবে কমেছে তিস্তার পানি।
গতকাল গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উচ্চতা ১৪ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৮৮ সেমি ও ঘাঘট নদীর পানি ১৫ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৮ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। করতোয়া নদীর পানি ২১ সেমি বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার ১৩৯ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তা নদীর পানি ১৩ সেমি হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ৫৬ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলায় ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৪ মিলিমিটার। গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা- এ চার উপজেলায় বন্যায় ২৭টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত সদরের কামারজানি, ঘাগোয়া, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে এসব এলাকার ঘরবাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার পানিবন্দি মানুষেরা গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। তবে কমেছে তিস্তার পানি। সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তুত রয়েছে।
জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বলেন, শুকনা খাবার, জিআর চাল, ক্যাশ মজুত রয়েছে। ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য নৌকা, স্পিডবোট প্রস্তুত রয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ইউনিয়নভিত্তিক বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র। প্রতিটি উপজেলায় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা চলমান রয়েছে।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিপাত কম থাকায় মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এতে শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আর পানিবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও বন্যায় কাঁচা সড়ক, বীজতলা, সবজি খেত ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন চিন্তা কপালে ভাঁজ ফেলেছে ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষের। তবে বাড়ছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ও মৃগী নদীর পানি। ফলে নতুন করে শেরপুর সদরের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তিনটি উপজেলায় পানিবন্দি রয়েছে হাজার দশেক মানুষ।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পানিবন্দি হয়েছেন অনেক মানুষ। রাস্তাঘাটসহ তলিয়ে গেছে আবাদি জমি। এ ছাড়া নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আলহাজ নাজমুল হক জানান, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনার পানি বিকাল ৩টার পর বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৩৭ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৩৭ সেন্টিমিটার। তবে দু-এক দিনের মধ্যে পানি কমতে শুরু করবে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ত্রাণ চাই না, বন্যা মোকাবিলায় স্থায়ী সমাধান চাই- এমন দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে সুনামগঞ্জে। গতকাল দুপুরে জেলা শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে বিশ্বজন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এর আয়োজন করে।