Bangladesh

কোনো কাজে আসছে না ৪১৩ কোটি টাকার প্রকল্প

বছরে ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল ও মাছ উৎপাদন পরিকল্পনা ব্যর্থ

তালিমনগরে ডুয়েল সিস্টেম পাম্পিং স্টেশন

মাত্র সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন না করেই ২০১৯ সালে ‘গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্পে’র কাজ শেষ করা হয়েছে। ফলে ৪১৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি কৃষক ও মৎস্যজীবীদের কোনো কাজেই আসছে না। এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজপণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে পানি উন্নয়ন বিভাগ, বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, এলজিইডি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ। প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি আত্মসাতেরও অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, সরকার ‘গাজনার বিল সংযোগ বাদাই নদী খনন, সেচসুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বহুমুখী প্রকল্প হাতে নেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০১০-১১ অর্থবছরে শুরু হয়ে চার দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এ সময়ে প্রকল্পব্যয় বাড়ে ৭০ কোটি টাকা। সংযোগ খাল খনন না করায় পাম্পিং স্টেশনের সাহায্যে বাদাই ও আত্রাই নদীতে পানি সরবরাহের করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিপণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়া পওর বিভাগের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান লিমিটেড ‘গাজনার বিল সংযোগ নদী খনন, সেচসুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ’ প্রকল্পের প্রাণ ৬৮ মিটার দীর্ঘ, ৯৮ মিটার প্রস্থ ও ১৫ মিটার উচ্চতার তালিমনগর ডুয়েল সিস্টেম পাম্পিং স্টেশনে, হাইওয়ে ব্রিজ ও সার্ভিজ ব্রিজ নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়েছে। পাম্পিং স্টেশনে ৮টি সাবমারসিবল মোটর বসানো হয়েছে। প্রতিটি মোটরের ক্যাপাসিটি ৪৫০ কিলোওয়াট, ৬০৩ এইচপি। প্রতিটি পাম্প মেশিনের পানি প্রবাহ (উত্তোলন ও নিষ্কাশন) ক্ষমতা ৫.০০ কিউমেক। ৮টি মেশিনের মোট ক্ষমতা ৪০ কিউসেক। ডুয়েল সিস্টেম এই পাম্পিং স্টেশনে সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে। এ কাজে ব্যয় হয়েছে ২২৬ কোটি টাকা। তালিমনগরে একটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন এবং বেড়ার কৈটোলা থেকে সুজানগরের তালিমনগর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু করা হয়েছে।

পাম্পিং স্টেশন পরিচালনার সুবিধার্থে একটি কন্ট্রোল রুম, আউটার বাউন্ডারী ওয়াল ও সিসি ক্লক পিসিং, পাম্পিং স্টেশনের উভয় পাশের গভীর খাল ভরাট, পুরাতন বাদাই নদীতে ৭০০ মিটার প্রধার খাল কনন করা হয়েছে। কিন্তু বাদাই নদীর সাথে যমুনা নদীর সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সংযোগ খাল খনন না করায় প্রকল্পটি কোনো কাজেই আসছে না।

তালিমনগর প্রকল্প এালাকা সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় ৪৯ কিলোমিটার বাদাই ও আত্রাই নদী খনন কর হয়েছিল, তা ভরাট হয়ে গেছে। শাখা খাল খনন অসমাপ্ত রয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এর কমান্ড এরিয়ার এক ফসলি জমি দুই ফসলি এবং দুই ফসলি জমি তিন ফসলিতে রূপান্তরিত হবে। ফসলের গড় উৎপাদন ১৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০০ শতাংশে উন্নীত হবে। এতে করে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিপণ্য উৎপাদন হবে। গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙার বিল ও মোস্তার বিলের অভয়াশ্রম এবং বাদাই ও আত্রাই নদী থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক পথে গাড়িতে কৃষকের ফসল ঘরে নেয়ার জন্য ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবমার্জেবল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সুজানগর এলজিইডি নির্মিত গাজনার বিলের সাবমার্জিবল সড়কটির দু’পাশ ধসে গেছে, উঠে গেছে সড়কের বিভিন্ন অংশ। সড়কের মধ্যবর্তী অংশে খোয়া উঠে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। সড়কটি যেহেতু বিলের ঠিক মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে চলে গেছে এ কারণে সড়কটি নির্মাণে পাথর ব্যবহারের কথাছিল। কিন্তু পাথরের পরিবর্তে নিম্ন মানের খোয়া দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করায় অল্প দিনেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৯ কিলোমিটার বাদাই ও আত্রাই নদী খনন করা হয়। প্রতি বছর ১০ শতাংশ ভাগ হিসেবে ৯ বছরে বাদাই ও আত্রাই নদীর প্রায় ৯০ ভাগ ভরাট হয়ে গেছে। ১১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সেকেন্ডারি ক্যানেলের মধ্যে জিয়ার জোলা, আত্রাই নদী, হিরন নদী, নাগনাখালী ও ভাদুরঠাকুরের জোলার মাত্র ৬৮ কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল, যা কোনো কাজে আসেনি। এ দিকে আত্রাই ও বাদাই নদী দু’টি শুকিয়ে যাওয়ায় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। নদীপাড়ের মানুষ গৃহস্থালির কাজ, মাছ চাষ ও সেচসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙার বিল ও মোস্তার বিলের মাছের অভয়াশ্রম শুকিয়ে যায়।

প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মৎস্য বিভাগ গাজনার বিলের চরদুলাই-পোতাজিয়া বিল অংশে ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মাছের অভয়াশ্রম করেছে। সেই জলাশয়টি শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানান, উল্লিখিত স্থানে এখন আর মাছের অভয়াশ্রমের অস্তিত্বই নেই। শুধু এখানেই নয়, গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙার বিল ও মোস্তার বিল অভয়াশ্রমের একই দশা। প্রকল্প এলাকায় এসব অভয়াশ্রম করার আসল উদ্দেশ্য ছিল মাছের পোনা অবমুক্ত করে এবং তালিমনগর সেøুইস গেট দিয়ে পদ্মা নদী থেকে মাছের পোনা বিল প্রকল্পে প্রবেশের মাধ্যমে দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধি করা। পাঁচটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য মৎস্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৯০ লাখ টাকা। যার ৯০ ভাগ অর্থ আত্মসাতের খাতে গচ্ছা গেছে বলে ওই সময় অভিযোগ ওঠে।

এ দিকে গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্পে বনায়নের কাজ শেষ হয়েছে কাগজে-কলমে। বনায়ন কাজে বন বিভাগকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৮৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পের নদী, প্রধান সেচ খাল ও সেকেন্ডারি সেচ খাল খননের পর এসব খালের দু’ধারের ডাইক বাঁধে গাছ লাগানো কথা ছিল। কিন্তু নদী খনন শেষ হওয়ার আগেই বনায়নের কাজ শেষ দেখানো হয়। প্রকল্প এলাকায় বনায়নের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের সুজানগর পওর উপবিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ইমরান হুসাইন জানান, যমুনা নদীর বেড লেভেলের শূন্য পয়েন্টে থেকে পাম্পিং স্টেশন পর্যন্ত সাড়ে ৭ কিলোমিটার ইনটেক চ্যানেল নানা কারণে খনন করা সম্ভব হয়নি। এতে এলাকাবাসী এই প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না।
এক প্রশ্নে তিনি জানান, প্রকল্পের শুরুতেই জমি হুকুম দখলের টাকা এলএ অফিসে জমা দেয়া আছে। নানা জটিলতায় জমি হুকুম দখল করা সম্ভব না হওয়া ইনট্যাক চ্যানেল খনন করা যায়নি। এ দিকে প্রকল্পে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাবে ইনট্যাক চ্যানেল খননের জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d