কোনো ব্যাংকে টাকা নেই, কোথাও উপচে পড়ছে ভল্ট, পাঁচ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিরেছে ২৫৯৩ কোটি টাকা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে জমা রাখছে মানুষ। ব্যাংকগুলো এখন আর বিশেষ ধার না পাওয়ায় অনেক আমানতকারীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য দিনে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা উত্তোলনের সীমার কারণে এসব ব্যাংকের খারাপ অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। এ রকম অবস্থায় কোনো কোনো ব্যাংকের ভল্ট খালি হলেও অনেক ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই। সীমার বেশি টাকা জমা পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিচ্ছে অনেক শাখা। গত পাঁচ দিনে বিভিন্ন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে দুই হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা জমা করেছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি ব্যাংক শাখায় ভল্টের একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারিত। সীমার বেশি টাকা এলেই তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সোনালী ব্যাংকের চেষ্ট শাখায় জমা করতে হয়। সরকার পতনের পর কয়েকদিন নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছিল ব্যাংকগুলো। তবে গেল সপ্তাহের পাঁচ দিনে যত টাকা নিয়েছে, জমা করেছে তার চেয়ে বেশি।
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে জমা হয় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত ১৮ আগস্ট তা ছিল ১০ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে নোটস ইন সার্কুলেশন বা প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ কমে গতকাল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৯ কোটিতে নেমেছে। গত ১৫ আগস্ট তা ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৬১ কোটি টাকা।
এর আগে সরকার পতনের পরদিন গত ৬ আগস্ট কারেন্সি ইন সার্কুলেশন ছিল তিন লাখ ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আর সরকার পরিবর্তনের পর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৯ দিনে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায় ৬ হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সার্কুলেশনে থাকা নোটের মধ্যে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সারাদেশে ১১ হাজারের মতো ব্যাংক শাখার ভল্টে ১৬ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো জমা থাকে। সার্কুলেশনে থাকা বাকি টাকা রয়েছে নাগরিকদের পকেট, ঘরের আলমারি, সিন্দুক কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
জানা গেছে, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্জিত অর্থ নানা উপায়ে অনেকেই ঘরে রেখেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বেশির ভাগই পলাতক। ঘরে টাকা রেখে তাদের কেউ কেউ এখন বিপদে আছেন। নিরাপদ বোধ না করায় বিভিন্ন উপায়ে তারা ভালো ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন।
আবার সরকার পতনের পর থেকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা তুলতে পারছে না মানুষ। এর কারণ, সরকার পতনের প্রথম সপ্তাহে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ, দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই লাখ এবং তৃতীয় সপ্তাহে তিন লাখ টাকা নগদ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ কারণে খারাপ অবস্থার ব্যাংক থেকে অনেকেই বড় অঙ্কের আমানত তুলতে পারছে না। বিশেষ করে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স ও ইউনিয়ন ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের পে-অর্ডার নগদায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
সমস্যাগ্রস্ত ন্যাশনাল, পদ্মাসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চাপ রয়েছে। সীমা তুলে নিলেই এসব ব্যাংকের প্রকৃত সংকট বোঝা যাবে। এসব ব্যাংক নানা উপায়ে গ্রাহকদের বোঝানোর চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারছে না। এসব ব্যাংক থেকে মেয়াদি আমানত ভাঙিয়ে অনেকেই পে-অর্ডার নিয়ে রেখেছেন।
অবশ্য সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে পুরোনো গ্রাহকদের অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। এর অন্যতম কারণ সরকার পতনের পর গত ৬ আগস্ট থেকে এস আলম ঘনিষ্ঠদের আর ইসলামী ব্যাংকে ঢুকতে দিচ্ছেন না কর্মীরা। তবে এস আলমের নিয়োগ দেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা এখনও অফিস করছেন। আবার ছয় ডিএমডিসহ আট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাদ পড়লেও এখন পর্যন্ত কারও গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও কারফিউর কারণে অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছিল। এখন স্থিতিশীলতা ফেরায় ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। আবার বাসায় টাকা রাখা অনেকেই নিরাপদ মনে করছে না। ব্যাংকগুলোও আমানত বাড়াতে প্রচুর চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে আবার টাকা ফিরতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সাধারণভাবে ঈদের সময় মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ে। তবে গত জুলাইজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যাপকভাবে কাছে রাখছিল। বিশেষ করে গত ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ছয়জনের মৃত্যুর পর ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ছুটি, কারফিউসহ বিভিন্ন কারণে নানা উপায়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করেন অনেকে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার আসায় কিছু মানুষের আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এ কারণে প্রতিদিনই মানুষের কাছে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ছিল।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশ আগে থেকেই এস আলমের ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সুবিধা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে ঘাটতি রেখেই লেনদেনের সুযোগ দেন গভর্নর থেকে পদত্যাগ করে পলাতক আব্দুর রউফ তালুকদার। এই তারল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি।
সাধারণভাবে কোনো ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলে চেক ক্লিয়ারিং হয় না। তবে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাব ঘাটতি রেখে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে চেক ক্লিয়ারিংয়ের সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল।
তবে ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো ব্যাংককে আর বিধিবহির্ভূত তারল্য সুবিধা দেওয়া হবে না। আবার কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে সেই দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেবে না।
জানা গেছে, এস আলমের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। গত মে মাসে ব্যাংকটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৮ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৩ হাজার ১৬৬ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৫৯ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১ হাজার ৮৫৫ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ১ হাজার ১৪২ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২২৪ কোটি ও কমার্স ব্যাংকের চলতি হিসাবে ২২২ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল।
বর্তমানে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। গত ৭ আগস্ট ব্যাংকটির চলতি হিসাবে জমা ছিল ৪ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। অন্যসব ব্যাংক ঘাটতিতে রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই ব্যাংকটিতে কর্মীদের শক্ত অবস্থানের কারণে নতুন করে কোনো টাকা বের করতে পারেনি এস আলম। পরিবর্তনের প্রথম সপ্তাহেই এস আলমের বেনামি ঋণের ৮৪৮ কোটি টাকার চেক ফেরত দেওয়া হয়। এ ছাড়া আগের অনেক গ্রাহক ব্যাংকটিতে আবার টাকা রাখতে শুরু করেছেন। এসব কারণে তাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।