Bangladesh

কোন পথে দেশ: দেশের শিল্প ও অর্থনীতি মহা সংকটে নিমজ্জিত যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ আর দিল্লির ‘সমর্থন’ বিদেশি হস্তক্ষেপ নয়!

পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত; একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত মানুষ; আমি শোষিতের পক্ষে’ (শেখ মুজিবুর রহমান)। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের প্রায় ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা এবং মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে ‘পাতানো’ ও ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন করে শোষক, অন্যদিকে ভোটের অধিকার হারানো ও নির্যাতন-দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ঠ শোষিত মানুষ। এ অবস্থায় বাংলাদেশের দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন ইস্যুতে পৃথিবী দুই ধরায় বিভক্ত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপানসহ প্রভাবশালী দেশগুলো শোষিত মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে একাট্টা। অন্যদিকে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাশিয়া, সমাজতান্ত্রিক চীন শোষকের পক্ষে। অন্যদিকে সুবিধাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী ভারত ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো অবস্থান নিলেও শোষকের পক্ষ্যেই মৌন সমর্থন। প্রশ্ন হচ্ছে কোন পথে হবে দেশের নির্বাচন? দেশ কী আবার ২০১৮ সাল ও ২০১৮ সালের মতো নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে? নাকি জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথে হাটবে? আসন্ন নির্বাচনে মানুষ কি ভোট দিতে পারবে নাকি ভোটকেন্দ্রে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ফের ভোটের মহড়া হবে? এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

উন্নয়নের মহাড়সকে উঠলেও অর্থনৈতিক মহা সংকটে নিমজ্জিত দেশ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে সেতু, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পের চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন এবং অসংখ্য ফ্লাইওভারের মতো দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও মানুষের আর্থিক অবস্থা চরম পর্যায়ে। অসংখ্যা পাটকল, চিনিকল, কাগজকল, বস্ত্রকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নতুন কোনো কর্মসংস্থান নেই। নিম্নবিত্ত লাখ লাখ পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গার্মেন্টসে রেড সিগন্যাল। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষ করে কাক্সিক্ষত কাজ পাচ্ছে না। এক বছর আগের ৮৫ টাকা ডলারের দাম এখন ১৩০ টাকায় উঠেছে। তারপরও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্যমূল্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গত এক বছরে যেসব গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে মানুষ গরীব হওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের বেকারত্ব ও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশির দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), ব্যাংকসহ কয়েকটি গবেষণা সংস্থা মানুষের নিদারুণ দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছে।

দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ এখন লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)-এর ঋণ নিয়েও ডলার সংকটের সুরাহা হচ্ছে না। এই যখন অবস্থা তখন দেশের রাজনীতি কার্যত বিস্ফোরণোন্মুখ। জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের দাবিতে চলছে একের পর এক অবরোধ কর্মসূচি। মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপির এই আন্দোলন কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছেন দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীও পৃথকভাবে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে পুলিশি গ্রেফতার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বিএনপির বেশির ভাগ নেতাই আত্মগোপনে। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ হাজার হাজার নেতা কারাগারে। তারপরও অবরোধ কর্মসূচিগুলো ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ‘অবরোধ কর্মসূচি’তে মৌন সমর্থন দিয়ে ঘরে বসে থাকছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের লাঠিয়াল বাহিনী রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মহড়া দিচ্ছে।

ঢাকার অলি-গলিতে লগি-বৈঠা নিয়ে প্রহরা বসিয়েছে। পুলিশের নাকের ডগায় এই মহড়া হলেও তারা কার্যত নীরব। অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে পথচারীদের তল্লাশি করছে, সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। মানুষকে গ্রেফতার করে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। ঢাকা বাস মালিক সমিতি সরকারকে খুশি করতে অবরোধে বাস চালানোর ঘোষণা দিলেও বাসের মালিকরা সড়কে বাস নামাচ্ছেন না। তারা বলছেন, যাত্রী না থাকায় বাস চালানোর খরচ উঠছে না তাই বাস নামাচ্ছি না। আবার পুলিশের ব্যাপক নজরদারির মধ্যেই অবরোধের আগের দিন কয়েকটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটছে। সবকিছুই যেন হয়ে গেছে স্বাভাবিক চিত্র।

বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি সমর্থন না করলেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিশাল বিশাল সমাবেশ করছে। গতকালও দলটির আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে। সিপিবি, বাসদ, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অধিকাংশ দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। তবে জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দলের মতো আবার আসন ভাগাভাগির পায়তাঁরায় তীর্থের কাকের মতো ওৎ পেতে রয়েছে।

এ অবস্থায় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে। তিনি এর মধ্যেই বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার অনুমতি নিয়েছেন। একদিকে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলছেন, ‘দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই; অন্যদিকে বলছেন সংবিধানের বিধান অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় হোক নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে’। তার অবস্থা যেন ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ অবস্থা। তিনি তার পূর্বসূরী কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ ও কে এম নুুরুল হুদার মতোই সরকারের তাবেদার হিসেবে পাতানো নির্বাচনের পথেই ধীরে ধীরে এগুচ্ছেন।

সংবিধানে ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ লেখা থাকলেও শব্দটি ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। দেশের মানুষ সব ক্ষমতার উৎস অথচ মানুষের ভোটের অধিকার নেই। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পাতানো নির্বাচনের পর থেকে জনগণ আর ভোট দিতে কেন্দ্রে যায় না। কেউ যেতে চাইলেও যেতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় শোষক দল জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকায় দেশে একটি সুবিধাভোগী চক্র তৈরি করেছে। ওই চক্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকার একদিকে জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে; অন্যদিকে ওই চক্রের সদস্যরা দুর্নীতি-লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করছে। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে কানাডায় বেগম পাড়া, দুবাইতে বাংলদেশি পল্লী, লন্ডনে বাংলাপল্লী, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে। ফলে ওই চক্র সরকারকে আবারও ক্ষমতায় রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তবে দেশের জনগণ ভোট দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসায় নাকি বিদেশি শক্তিগুলো ক্ষমতায় বসায় তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। মানবাধিকার রক্ষায় র‌্যাবের কয়েকজন সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন নিজেদের স্বার্থেই চাচ্ছে বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু চীন ও রাশিয়া চায় তাদের দেশের মতো পাতানো নির্বাচন করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকুক। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভারত নানা পন্থায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে দুতিয়ালি করেছে। তবে চীন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অবস্থান এক হওয়ায় দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না।

এর মধ্যে গত ১০ নভেম্বর দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত পঞ্চম ‘টু প্লাস টু’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নিজ নিজ দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। ওই বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কাত্রা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ সময় উভয় পক্ষই বাংলাদেশের বিষয়ে স্পষ্টভাবে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। মূলত এই আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়টিও উঠে আসে। বাংলাদেশের উন্নয়ন বা নির্বাচনের কথা যখন আসে, তখন এটা তাদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে। বাংলাদেশ আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার। সে হিসেবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং দেশটির জনগণ নিজেদের জন্য যে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল অবস্থা দেখতে চায়, আমরা সেই আকাক্সক্ষাকেই সমর্থন দেবো।

এ সংবাদ সম্মেলনের পর বিবিসির সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদদাতা মৌম্য বন্দোপাধ্যায় নিজ নিজ গণমাধ্যমে ‘বাংলাদেশের নির্বাচন : যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই প্রতিবেদন দেখে কবি শামসুর রাহমানের ‘কান নিয়েছে চিলে’ কবিতার ‘চিলের পিছনে ছোটা’র মতো সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতে হুবহু প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অতঃপর এতোদিন যারা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে ‘নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ মানব না’, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রভু’, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো বিদেশি প্রেসক্রিপশন মানা হবে না’ ইত্যাদি বলে দেশপ্রেমের শোরগোল তোলেন; তারা কার্যত ‘দিল্লির অবস্থান স্পষ্ট করেছেন’ ভুয়া খবর পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। দিল্লি পক্ষে রয়েছে ‘ফেইক নিউজে’ তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। দিল্লি যেন তাদের কাছে বিদেশ মনে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন কোন পথে হাটছে? জনগণ তাদের ভোটের অধিকার ফিরে পাবে নাকি ফের পুরোনো নিয়ন্ত্রিত ঝুড়িতে ভোট পড়বে?

Show More

8 Comments

  1. Hello there! This is my first comment here so I just wanted to give a quick shout out
    and tell you I really enjoy reading through your blog posts.

    Can you suggest any other blogs/websites/forums that deal
    with the same subjects? Thanks a ton!

    Feel free to surf to my site … vpn meaning

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button