কোম্পানি নিচ্ছে দুধের স্বাদ, খামারির মনে বিষাদ
সিরাজগঞ্জের তাড়াশের শরিফুল ইসলামের খামারের ১৬ গাভি থেকে প্রতিদিন দুধ মেলে ২০০ লিটার। এক বছর আগেও প্রতি লিটার দুধ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করতেন ৪৫-৪৯ টাকায়। খামার পরিচালনা খরচ বাড়বাড়ন্ত থাকলেও দুধের লিটার ওই ৪৫-৪৯ টাকার ছকেই আটকা। এ নিয়ে শরিফুলের মনে যন্ত্রণার দহন। দুধের দামের এমন বেদনার সারথি শরিফুল শুধু একা নন, সারাদেশের সব প্রান্তিক খামারিরই একই নিয়তি।
খামারিদের যখন এমন বোবাকান্না, তখন প্রাণ, আড়ং, আকিজ, মিল্ক ভিটার মতো কোম্পানি লিটারে দাম বাড়িয়েছে ১০ টাকা। এক মাস আগেও প্রতি লিটার তরল দুধের দাম ছিল ৯০ টাকা, এখন তা শতক ছুঁয়েছে। বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, প্যাকেজিংসহ সব খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দুধের দামে।
খামারিরা বলছেন, কোম্পানিগুলো লিটারে ১০ টাকা বাড়ালেও প্রান্তিক খামারিকে দেওয়া হচ্ছে যৎসামান্য। দুধ উৎপাদনকারী নয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানই বাড়তি মুনাফা লুটছে। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্তের খাবার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে প্রোটিনসমৃদ্ধ এ খাদ্য। এতে শিশুর পুষ্টি ঘাটতির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুধের দাম পর্যালোচনার জন্য তদারকি কোনো সংস্থা নেই। কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। এবারও বলা নেই, কওয়া নেই লিটারে ১০ টাকা দাম বাড়িয়ে দুধের ননী খাচ্ছে তারা। এ জন্য নানা খাতে খরচ বাড়ার ছুতা দাঁড় করিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাজার স্বাভাবিক রাখতে মাংসের মতো তরল দুধের দাম নির্ধারণেরও পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
বছর বছর দাম বাড়াচ্ছে কোম্পানি
তরল দুধের দাম নতুন করে যেমন বাড়িয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো, তেমনি বাড়ানো হয়েছে গুঁড়া দুধের দামও। সঙ্গে বেড়েছে দুগ্ধজাত পণ্যের দাম।
বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধের প্যাকেটে লেখা দর যাচাই করে দেখা গেছে, তারা নতুন দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি লিটার ১০০ থেকে ১০৫ টাকা। এই দর আগের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। এ নিয়ে দুই বছরের মাথায় তরল দুধের দাম লিটারে ২০ টাকা বাড়ল। মিল্ক ভিটা তাদের ওয়েবসাইটে লিটারপ্রতি তরল দুধ ৯০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম লিটারে ছিল ৮০ টাকা। ওই বছরই কোম্পানিগুলো ১০ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা করে। দুই বছর পর গত নভেম্বরে তরল দুধ লিটারে ১০ টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।
দুগ্ধজাত যত পণ্য আছে, সবকটির দামও বেড়েছে। আধা লিটার মিষ্টি দইয়ের দাম এখন ১৩০ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ৮০ টাকা। ২০১৮ সালে এই দাম ছিল ৬৫ টাকা। ২০১৮ সালে ৯০০ গ্রাম ওজনের এক কৌটা ঘি বিক্রি হয়েছে কোম্পানিভেদে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়। এখন সেই ঘি ১ হাজার ৫০০ টাকা। মিষ্টি, আইসক্রিম, বাটার, লাবাং, ফ্লেভারড মিল্কসহ দুগ্ধজাত যত পণ্য রয়েছে, সবকটিই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে।
তবে দুই বছর ধরে শুধু আটকে আছে খামারি পর্যায়ে দুধের দাম। প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, ‘আমরা খামারি পর্যায়ে তরল দুধের দাম বাড়িয়েছি। প্রক্রিয়াজাত ও ভোক্তা পর্যায়ের প্যাকেজিংয়ের কারণে দুধের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।’
১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মিল্ক ভিটা না পেরেছে খামারির আস্থা অর্জন করতে, না পেরেছে ভোক্তার কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে দুধ-মিষ্টান্ন নিয়ে হাজির হতে। শুধু খামারির কাছ থেকে দুধ কেনা আর জনগণকে বেশি দামে তা গেলানোয় সমবায়ভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল নানা কর্মসূচির মাধ্যমে খামারির উন্নয়ন করা। মিল্ক ভিটা খামারির কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করছে লিটারপ্রতি ৪৫-৪৭ টাকায়। অথচ বাজারে মিল্ক ভিটার প্যাকেটজাত ১ লিটার দুধের দাম ১০০ টাকা।
মিল্ক ভিটা বাঘাবাড়ী ঘাট কারখানার আওতায় এই এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ সমবায় সমিতি। এসব সমিতির আওতায় বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার গবাদি পশু লালন-পালন করছেন সমিতির সদস্যরা। এসব গো-খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছে মিল্ক ভিটা।
মিল্ক ভিটার পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মনির বলেন, বিগত সরকার মিল্ক ভিটাকে ধ্বংস করে গেছে। শেখ হাসিনা তাঁর চাচাকে মিল্ক ভিটার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, খামারিদের রক্ষা করাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে গোখাদ্যের দর অনুযায়ী দুধের দাম নির্ধারণ করা হবে। আগে ভর্তুকি দেওয়া হতো। সেটাও বিগত সরকারের আমলে বন্ধ করা হয়েছে। আমরা ভর্তুকি দেব। খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করব। খামারি যেন দুধের ন্যায্য দাম পান, এ জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৬ মাসে ৪০০ গ্রামেই বেড়েছে ২০০ টাকা
গত ছয় মাসে ৪০০ গ্রামের টিনজাত দুধের দাম ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আকলিমা বেগম বলেন, মাসে ৮ প্যাকেট ন্যান দুধ কিনতেই খরচ হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার টাকা। দুই মাস আগেও এই খরচ ছিল ৮ হাজার টাকা। এক বছর আগে যে গুঁড়া দুধের প্যাকেটের দাম ৫৯০-৬০০ টাকা ছিল, তা এখন ৭৫০ টাকায় ঠেকেছে। ন্যান, সেরেলাক, বায়োমিল, প্রাইমাসহ পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর দাম প্যাকেটপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বলেন, বর্তমানে ৪০০ গ্রাম টিনজাত বায়োমিল দুধ ৮১০ টাকা, ৪০০ গ্রামের টিনজাত ল্যাকটোজেন ৮২০ টাকা এবং ৪০০ গ্রাম টিনজাত ন্যান দুধ ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাদের লাভ খুব সামান্য, যা করার কোম্পানি করে।
খামারিরা লোকসানে
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১.৪০ কোটি টন দুধ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম সারির দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো ৭ থেকে ৮ লাখ টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করে দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে। বাকি খামারিরা মিষ্টির দোকান ও খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। খোলাবাজারে বিভিন্ন সময়ে প্রতি লিটার দুধ ৬০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হয় বলে জানান খামারিরা। প্রতিনিয়ত চাহিদার ওঠানামার কারণে বড় খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে সবসময় বিক্রি করতে পারেন না বলে বাধ্য হয়েই কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দুগ্ধ খামারি আছেন প্রায় ৩০ হাজার। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় ৫ লাখ লিটার। খামারির কাছ থেকে বড়-ছোট দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি দিনে দুধ সংগ্রহ করে সাড়ে ৩ লাখ লিটার। বড় কোম্পানির মধ্যে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ইগলু ও আকিজের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র রয়েছে শাহজাদপুরে।
উল্লাপাড়ার পশ্চিমপাড়া গ্রামের খামারি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুধের টাকা দিয়ে গরুর খাবার কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। খাবারের দামের চেয়ে দুধের দাম পেলে কিছুটা আয় হতো।
একই উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর ইউনিয়নের সুজয় গ্রামের খামারি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করছি ৪২ টাকায়। এই দামে দুধ বেচে গরুর খাবার কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সবকিছুর দাম বেড়েছে, অথচ আমাদের এখানে দুধের দাম কমছে। কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, তেলের দাম বেশি, তাদের গাড়িতে দুধ পাঠাতে অনেক খরচ হয়, তাই দুধের দাম কম দিচ্ছে। আমাদের বাধ্য হয়ে কোম্পানির দেওয়া কম দামই নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এত বেশি দামে গোখাদ্য কিনে কম দামে দুধ বেচে আর পোষাতে পারছি না। কীভাবে খামার চালাব বলেন!
পাবনার ফরিদপুরের ডেমরা গ্রামের খামারি জাকিরুল ইসলাম বলেন, কোম্পানিগুলো তাদের পাস্তুরিত তরল দুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমাদের এখানে কমিয়ে দিয়েছে দুধের দাম। কোম্পানিগুলো খামার না করেই বড়লোক হচ্ছে আর আমরা খামার করে হচ্ছি নিঃস্ব। আমাদের দিকে সরকারের কোনো নজর নেই। বেশ ক’দিন ধরে আমার খামারের গরুর দুধের ঘনত্ব কমে গেছে। তাই এখন প্রতি লিটার ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
ভাঙ্গুরার খামারি মো. খোকন বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন আমি ৬০০ লিটারের মতো দুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। ৪.৫ শতাংশ ফ্যাট থাকলে দাম পড়ে ৪৫ টাকা; ফ্যাটের পরিমাণের ওপর দাম ওঠানামা করে। দুই বছর আগেও এ রকমই ছিল। এক বছরে দু-তিনবার যেটুকু দাম বাড়ানো হয়েছিল, তা আবার ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, ছয় মাস আগে ডলারের দর যা ছিল, এখনও তাই আছে। প্রক্রিয়াজাতের জন্য তারা কেন ১০ টাকা বাড়িয়েছে, এটা বোধগম্য নয়।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) দুগ্ধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দুধের বাজারজাতকরণের প্রতিবন্ধকতায় হোঁচট খাচ্ছেন খামারিরা। প্রান্তিক পর্যায়ে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত বা সংরক্ষণের অপর্যাপ্ত সুবিধা ও পণ্য বহুমুখীকরণের সক্ষমতা না থাকায় খামারিরা পড়ছেন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহন সমস্যা। এসব কারণে অনেক সময় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক খামারি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, খাদ্য হিসেবে ঘাসের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বলছি খামারিদের। এজন্য সারাদেশে ঘাসের চাষও বাড়ছে। আর যারা ঘাসের ওপর নির্ভরশীল, তারা লাভে থাকছেন।
ভোক্তা বিপাকে, পুষ্টিহীনতার শঙ্কা
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য তো বটেই, বড়দের খাদ্য তালিকায়ও দুধ থাকা উচিত বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্তের খাবার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে দুধ। এতে ওই সব পরিবারে শিশুর পুষ্টি ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগের বাসিন্দা মাহমুদা আক্তা ডলি। তিনি বলেন, ‘বাসায় দুই শিশুসন্তানসহ বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। দিনে অন্তত এক লিটার দুধ তো লাগে। এখন আধা লিটারের প্যাকেট কিনতে লাগে ৫০ টাকা, মাসে দেড় হাজার টাকা। এই বাজারে এত খরচ করে তো কুলিয়ে উঠতে পারছি না।’
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, দুধ শিশুদের প্রয়োজনীয় খাবার। ক্যালসিয়াম থেকে শুরু করে অন্য অনেক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পূরণ করে দুধ। শিশুর শারীরিক বর্ধন হলেও এর অভাবে মানসিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। শিশু বড় হলেও ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে। ফলে কর্তৃপক্ষকে দুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।