ক্লাস করেন না পরীক্ষায় ফেল তবু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!
- ৫ বছরে একটি ক্লাস না করেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হচ্ছেন তিনি
- স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায় থেকে তদবিরের কারণে প্রশাসন থেকে ডা. পবিত্রর পরীক্ষা নিতে চাপ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বিভাগের শিক্ষকদের
- কোথাও সুপারিশ করিনি : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
- বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ উপাচার্যের
- ৬টি ব্লক পরীক্ষায় অংশ নিলেও একটিতেও পাস হতে পারেননি ডা. পবিত্র
- ডা. পবিত্রকে পাস করাতে গিয়ে ফেইজ ‘এ’র ২২ শিক্ষার্থীর সবাইকে ঢালাও পাস দেওয়া হয়
এমবিবিএস পাস করার পর একজন চিকিৎসককে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অংশ নিতে হয় ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ও মাস্টার্স অব সার্জারি (এমএস) কোর্সে। পাঁচ বছরের এ দুটি কোর্সের পরীক্ষা হয় ফেইজ ‘এ’ এবং ফেইজ ‘বি’এ দুই ধাপে। ফেইজ ‘এ’তে দুই বছরের প্রশিক্ষণসহ সর্বোচ্চ পাঁচবার পরীক্ষা দেওয়া যায়। এ পরীক্ষায় পাস করার পর ফেইজ ‘বি’তে তিন বছরের প্রশিক্ষণসহ সর্বোচ্চ সাতবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায়। ফেইজ ‘এ’ ও ‘বি’র চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে একজন শিক্ষার্থীকে যেসব ব্লকের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়, তাতে উত্তীর্ণ হতে না পারলে প্রশিক্ষণসহ পুরো কোর্সই বাতিল হয়ে যায়।
তবে এসব নিয়ম বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের এমডি কোর্সের এক শিক্ষার্থীকে ফেইজ ‘বি’র চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্র্তৃপক্ষ। এ শিক্ষার্থীর নাম ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ। তিনি এমডি কোর্সের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) এবং রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ফেইজ ‘বি’তে ছয়টি ব্লক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একটিতেও পাস করতে পারেননি ডা. পবিত্র। ফলে নিয়ম অনুযায়ী তার চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে বিষয়টি রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। যার একটি কপি দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ছয়টি ব্লক অসম্পূর্ণ থাকায় নিয়ম অনুযায়ী ডা. পবিত্রর ফেইজ ‘বি’র ফাইনাল পরীক্ষায় বসার সুযোগ নেই। বিষয়টি বিভাগের পক্ষ থেকে উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নানসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা সবকিছু জেনেও ডা. পবিত্রকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দিতে বিভাগকে চাপ দেন। এ নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বিভাগের শিক্ষকদের দেনদরবার হয়। তাদের অনড় অবস্থানের কারণে একপর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠনের নেতাদের সুপারিশের কারণেই তার পরীক্ষা নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমি অতীতে কিংবা বর্তমানে কোনো অনৈতিক বিষয়ে কোথাও সুপারিশ করিনি। এমনকি ভবিষ্যতেও করব না।’
বিএসএমএমইউর উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ বিভাগের চেয়ারম্যান ও অনুষদের ডিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিভাগের একাধিক শিক্ষক বলেন, ডা. পবিত্রর ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে বিভাগের শিক্ষকরা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। কেননা তাকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দিতে না চাইলেও তাদের বাধ্য করা হয়েছে। ডা. পবিত্র ফেইজ ‘এ’ ও ফেইজ ‘বি’র পাঁচ বছরের কোর্সে এক দিনও ক্লাস ও টিউটোরিয়ালে অংশ নেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ডা. পবিত্রর সখ্য থাকার কারণে তার সুপারিশে ফেইজ ‘এ’র চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাকে অংশ নিতে দিতে হয়। একই পথে হাঁটছেন বর্তমান উপাচার্যও। সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে সখ্যের খাতির দেখিয়ে ডা. পবিত্র কখনো ক্লাসে উপস্থিত হতেন না। দুই-তিন মাস পরপর এসে একসঙ্গে হাজিরা খাতায় সব স্বাক্ষর করে যেতেন।
তারা আরও বলেন, ফেইজ ‘এ’র চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে ডা. পবিত্রকে পাস করানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন বিভাগের শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ও টেলিফোনে ‘অনুরোধ’ করেছিলেন। তার এমন চাপের ফলে বিভাগের শিক্ষকদের এক সভায় তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ডা. সালাহউদ্দিন আল আজাদ বলেছিলেন, “পবিত্রকে পাস করিয়ে দিতে হলে আর পরীক্ষা নেওয়ার দরকার নেই, সবাইকে পাস করিয়ে দিতে হবে। আমরা রাগ ও ক্ষোভে ফেইজ ‘এ’র চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ২২ শিক্ষার্থীকেই উত্তীর্ণ করে দিই; যা এর আগে দেশের ইতিহাসে কখনো হয়নি।”
এমডি কোর্সের এক শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন দরদ বিস্ময়কর উল্লেখ করে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, এমডি ডিগ্রি অর্জনের পর ডা. পবিত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে চেম্বার করবেন, যা এই বিভাগের জন্য লজ্জাজনক। শুধু পরীক্ষায় অংশ নেবেন না, তাকে পাসও করিয়ে দিতে হবে। যে পদ্ধতিতে ফেইজ ‘এ’তে করা হয়েছিল, একইভাবে এবারও ডা. পবিত্রকে উত্তীর্ণ করা হবে। তার যে থিসিস জমা পড়েছে সেখানে এত বেশি অসংগতি থাকার পরও তাকে আটকানো হয়নি।
এ বিষয়ে সার্জারি অনুষদের ডিন মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বিভাগ থেকে ডা. পবিত্রের বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। যেহেতু বিভাগ ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে তাই আমি (পরীক্ষায় বসার অনুমতিপত্রে) স্বাক্ষর করেছি। বিভাগ যখন একজন শিক্ষার্থীকে ক্লিয়ারেন্স দেয়, তখন আমি ধরে নিই সব ঠিক আছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। চেম্বারে গিয়ে তার দেখা মেলেনি। এমনকি একাধিকবার ফোনে কল দেওয়া হলেও সাড়া দেননি তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে এমডি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন ডা. পবিত্র। ফেইজ ‘এ’তে চারবার পরীক্ষা অংশ নিয়েও তিনি পাস করতে পারেননি। এমনকি একাধিকবার নকলসহ শিক্ষকদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেষবার পরীক্ষায় পাস না করলে প্রশিক্ষণসহ পুরো কোর্সই বাতিল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন ডা. পবিত্র। তখন সে সময়ের উপাচার্য বিভাগের চেয়ারম্যানসহ একাধিক শিক্ষককে চাপ দেন তাকে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে সময় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন আল আজাদ।
এমডি ও এমএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাসের হারের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালের এমডি এবং এমএস সেশনের ফলাফলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেইজ ‘বি’র চূড়ান্ত পরীক্ষায় রেডিওলজি ও ইমেজিংসহ চার বিভাগের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি। একইভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ আরও তিনটি সরকারি মেডিকেলের একাধিক বিভাগের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এমডি ও এমএস কোর্সের একজন শিক্ষার্থীকে অনেক পড়াশোনার পাশাপাশি অনুশীলন করতে হয়। ক্লাস, টিউটোরিয়াল, থিসিস, থিসিসের জন্য ডেটা কালেকশন সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগের ধাপের এ কোর্সগুলোর শিক্ষার্থীদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। অথচ ডা. পবিত্র রেডিওলজি বিভাগের এমডি কোর্সের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল), রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। একজন শিক্ষার্থী যেখানে দিনরাত চেষ্টা করেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে এমডি কোর্সের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না, সেখানে ডা. পবিত্রর পড়াশোনার পাশাপাশি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা বিস্ময়কর।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ডা. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কারও যদি ব্লক অসম্পূর্ণ থাকে তাহলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য বিভাগীয় প্রধান যদি সুপারিশ করে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তার ব্লক কমপ্লিট।’
এদিকে ফেইজ ‘বি’র শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হওয়ার জন্য তিন বছরের শিক্ষা ছুটি নেন ডা. পবিত্র। কিন্তু ২০২১ সালে এই ছুটিকে তিনি কর্তব্যকালীন ছুটি দেখিয়ে রেডিওলজি বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন; যা আইনের ব্যত্যয়।
রেডিওলজি বিভাগের এমডি কোর্সের ফেইজ ‘বি’র একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডা. পবিত্রকে তারা কখনো ক্লাসে দেখেননি। এমনকি তাকে টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অংশ নিতেও দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার জন্য রোগীর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। যে কারণে কোর্সের শিক্ষার্থীকে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাফ, এক্স-রে, এমআরআইয়ের মতো রিপোর্ট দেখতে ও লিখতে হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজেও তাকে কখনো অংশ নিতে দেখেননি তারা। এসব বিষয় জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এমডি কোর্সে ডা. পবিত্রর সহপাঠীরা।