Trending

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বাংলাদেশ চায় ন্যায়বিচার স্বার্থের দোলাচলে অগ্রগতি সামান্য

বিশ্বনেতাদের নির্লিপ্ততায় পরিবেশকর্মীদের বিক্ষোভ

ধনী বিশ্বই সৃষ্টি করেছে জলবায়ু সংকট। সেই তুলনায় খুব কম মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করা দরিদ্র বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন অর্থায়নের। অথচ জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ২৯-এর সময় ফুরিয়ে এলেও অর্থায়নের বিষয়ে এখনও হেলদোল নেই। আগামী শুক্রবার আজারবাইজানের বাকুর এবারকার আয়োজনের পর্দা নামছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। তাই দেশগুলোর কাছে দ্রুত কার্যকর ও সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

জলবায়ু সম্মেলনে যত দর কষাকষি, তা ঠিক অর্থায়নের জায়গাতেই আটকে আছে। অর্থ নিয়ে যতটা বাগাড়ম্বর, তার বাস্তব ফল খুবই নগণ্য। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জাপটে ধরে ফল আনতে চাইলেও মিলছে না সুবাতাস। ফলে গতকাল দিনভর বাকুতে পরিবেশকর্মীরা ক্ষোভ ঝাড়েন। পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভে বহু প্ল্যাকার্ডে উচ্চারিত হচ্ছে– ‘গ্রিনওয়াশ’; যার অর্থ– মূল সত্য চাপা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে মানুষকে। সম্মেলনের ভেতরের আলোচনায় বিভিন্ন দেশের নেতারা বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর জন্য যেসব বড় প্রতিশ্রুতি আওড়াচ্ছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন, এতে পরিবেশবাদীরা রাখতে পারছেন না আস্থা। বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা লোকজন, তা সে সরকারি প্রতিনিধি হোক আর পর্যবেক্ষক– খোলা গলায় নানা ফোরামে, সংবাদ সম্মেলনে বলছেন শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না। ‌তাদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে যথেচ্ছভাবে কয়লা-তেল-গ্যাস পুড়িয়ে গুটিকতক ধনী দেশ বাকি বিশ্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন ক্ষতিপূরণ নিয়ে টালবাহানা করছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর অর্থায়নে যেভাবে বেসরকারি পুঁজিকে নিয়ে আসার চেষ্টা ধনী দেশগুলো করছে, এর উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে সন্দিহান।

বাংলাদেশের জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিপিআরডির শামসুদ্দোহা ভয় পচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখন পশ্চিমা দেশগুলো ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছে। জলবায়ু সম্মেলনে এসে এই উন্নয়নকর্মী বলেন, তাদের অনেক উদ্বৃত্ত পুঁজি রয়েছে। কার্বনকে পণ্য করে এখন তারা গরিব দেশগুলোতে পুঁজি খাটাতে চাইছে। এক ধরনের কার্বন ক্যাপিটালিজম শুরু হচ্ছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। 
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচারও চান সৈয়দা রিজওয়ানা

এক দিন বিরতির পর গতকাল সোমবার থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের অংশগ্রহণে জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এদিন একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। কপ২৯ এ অনুষ্ঠিত ‘প্রাক-২০৩০ উচ্চাভিলাষ’ বিষয়ক বার্ষিক উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ২০৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য পূরণে উন্নত দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন কমাতে হতে হবে উদ্যোগী। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা মোকাবিলা করছে, তা তুলে ধরে সমন্বিত বৈশ্বিক উদ্যোগের ওপর জোর দেন। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উল্লেখ করেন, এই বছর দুটি ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি করেছে, যা জাতীয় বাজেটের ১.৮ শতাংশের সমান। গত ১৮ মাসে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ১৫ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ হলেও দেশটি চরম ক্ষতির শিকার।

তিনি আরও বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২২ শতাংশ নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ২৭ মিলিয়ন টন নির্গমন শর্তহীনভাবে এবং ৬১ মিলিয়ন টন শর্তসাপেক্ষে কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজস্ব তহবিল এবং ১৩৫ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা। জলবায়ু ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে উন্নত দেশগুলোকে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) শক্তিশালী করতে হবে, বাজার পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে উচ্চমানের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।
পরে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির জন্য বৈশ্বিক কার্যকরী ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

একই দিন সকালে পরিবেশ উপদেষ্টা নেপালের বন ও পরিবেশমন্ত্রী আই বাহাদুর শাহি ঠাকুরির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আলোচনা হয় জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার প্রশমন, অভিযোজন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে। বাংলাদেশের পরিবেশ উপদেষ্টা জানান, নেপাল বাংলাদেশকে আরও জলবিদ্যুৎ দিতে আগ্রহী। এ ছাড়াও লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করার ওপর জোর দেন সৈয়দা রিজওয়ানা। বৈঠকে জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জানুয়ারিতে। বৈঠকে উপস্থিত থাকবে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ। নেপালের পরিবেশমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রায় একই। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো সীমানা মানে না। এর প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

জলবায়ু সম্মেলনের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-আইএমএফ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত ‘রোড টু নেট জিরো নেভিগেটিং দ্য এনার্জি ট্রানজিশন ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক এক সাইড ইভেন্টে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশ। এই রূপান্তরের জন্য সময়োপযোগী এবং সমতাভিত্তিক আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে মোট জ্বালানি ব্যবহারের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। চীনকে বাংলাদেশে সোলার ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট স্থানান্তরের অনুরোধ জানানো হয়েছে, যা আমদানিনির্ভরতা কমাবে। এ ছাড়া সোলার প্যানেলের ওপর কর কমানোসহ সংশ্লিষ্ট নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের আরেকটি আয়োজনে বক্তব্য দিতে গিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আপডেটেড এনডিসি বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন, যার মধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে অর্জন করবে। তবে বাকি অংশ আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তিনি জানান, বাংলাদেশ আগামী বছর এনডিসি ৩.০ জমা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

গতকাল বিকেলে রিজওয়ানা হাসান জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘আর্টিকেল ৬ ইমপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপ’ সেশনে অংশ নেন। 

তিনি জাপানের কাছে সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

নির্দেশ উপেক্ষা করে স্লোগান

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের কড়া নির্দেশে শুরুতে পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীরা ভেন্যুতে ঢুকতে না পারলেও পঞ্চম দিনে তাদের বিক্ষোভ দেখানোর অনুমতি দেওয়া হয়। তখন থেকে একেক স্পটে বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা। তবে স্লোগান দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বিশ্ব মোড়লদের সাফ কথা, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে জলবায়ু সম্মেলনস্থলে বিক্ষোভ করা যাবে, তবে দেওয়া যাবে না স্লোগান। গতকাল সেই নির্দেশ অমান্য করে শত শত পরিবেশকর্মীর স্লোগানে মুখর করে তুলেছে বাকু অলিম্পিক স্টেডিয়ামের সম্মেলনস্থল। যেখানে এক কাতারে অংশ নেন বাংলাদেশ থেকে আসা পরিবেশকর্মী থেকে শুরু করে গাজায় গণহত্যায় ঘর ও স্বজনহারারা।

বাংলাদেশের লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ গতকাল বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, গেল ২৮টি জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দাবি করলেও বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের অঙ্গীকার বারবার ভেঙেছে। অনেকে বলে– তারা উন্নত দেশ, কীসের উন্নত দেশ। তারা বৃহৎ দূষণকারী দেশ, ভয়াবহ কার্বণ দূষণের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী। তারা বাধ্য পৃথিবী বাঁচানোর জন্য এই ক্ষতিপূরণ দিতে। তবে এই তহবিল বা অর্থায়ন কোনোভাবেই কোনো শর্তাধীন হতে পারবে না, ঋণ বা চুক্তি হতে পারবে না। কোনো কার্বন-ক্রেডিট বা নতুন বিপজ্জনক প্রযুক্তি বা বীজ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এই তহবিল ব্যবহৃত হতে পারবে না। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর লোকায়ত ও স্থানীয় বৈচিত্র্যনির্ভর অভিযোজন এবং সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি পূরণে এই তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে আসা বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, কপ২৯-এর শেষ দিনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সম্মেলনে কোনো কার্যকর চুক্তি না হয়, তবে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সম্মেলনে লবিস্টদের সক্রিয় উপস্থিতি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার বদলে তাকে শক্তিশালী করছে, যা বিশ্ব জলবায়ু সংকট সমাধানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির উত্থান এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ানোই একমাত্র জলবায়ু সংকট মোকাবিলার চাবিকাঠি হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

তিনি বলেন, উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। জলবায়ু সহায়তার ব্যর্থতা অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আমি আশা করছি, দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করবে। এই সম্মেলনের সাফল্য শুধু বর্তমান সংকট মোকাবিলাই নয়, ভবিষ্যতের জলবায়ু নীতির দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button