Bangladesh

ক্ষোভ ঘৃণার সাক্ষী গণভবন

সেই গণভবন এখন একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। ৫ আগস্টের আগে এ বাড়িতে কড়া পাহারায় সপরিবার থাকতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সেখানে ঢুকে পড়ে লাখো মানুষ। ক্রোধে, ক্ষোভে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট চলে। পরিত্যক্ত সেই বাড়িটি এখন শেখ হাসিনার ওপর মানুষের ক্ষোভ আর ঘৃণার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে আছে। বাড়িটির পাহারায় এখন আনসার সদস্যরা। নিয়ন্ত্রণে আছে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় জাদুঘরের অনুমতি নিয়ে গণভবনে প্রবেশ করে ঘুরে দেখার সুযোগ হয় এই প্রতিবেদকের।

জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর-পশ্চিমে ২ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডানেই লাল দোতলা বাড়িটিতেই ছিল শেখ হাসিনার আবাস। এ ভবনের দক্ষিণে বিশাল মাঠ, সেখানে শিশুদের দু-একটি খেলনা রাইড। মাঠের সবখানে লম্বা ঘাস।

পূর্বে পুকুর এবং উত্তরে ফাঁকা স্থান ছেড়ে কিছুটা দূরে জিআই তারের জালে ঘেরা টেনিস কোর্ট। সঙ্গে লাগানো পানির পাম্প ও গরুর খামার। এ ছাড়া কর্মচারীদের থাকার কয়েকটি ঘর। আর পশ্চিমে মিরপুর সড়ক পর্যন্ত প্রায় বিস্তীর্ণ চাষের জমি। যেখানে ধান, গম, ভুট্টা ও সবজিসহ নানা দেশি ফলের চাষ। মিরপুর সড়কসংলগ্ন সার্বক্ষণিক বন্ধ থাকা ১ নম্বর গেটের পাশে এবং ২ নম্বর গেটের পাশেও দেখা গেছে কৃষি চাষাবাদের কিছু উপকরণ। কয়েকটি ঘাস-কাটার মেশিন। চারদিকে নানা গাছ-গাছালিতে ভরা। ১ নম্বর গেটের পাশে বিদ্যুতের সাবস্টেশন ও জেনারেটর মেশিন। ভিতরের দিকে যেতে রাস্তার পাশে অন্তত ৭টি বিধ্বস্ত গাড়ি। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা সীমানাপ্রাচীর।

এখানে কথা হয় আনসার সদস্য মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা আসছি অল্প কয়েক দিন হলো। কোথায় কী আছে কিছু বলতে পারি না।

মূল ভবনের পূর্বের দরজার পাশে রাখা আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত গোলাম নাফিজের দেহ বহনকারী রিকশাটি। সেই রিকশাটি হৃদয় স্পর্শ করেছে সবারই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ছবি দেখে চোখের কোণে জল আসেনি এমন মানুষ হয়তো কমই আছে। রিকশাটিকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে গণভবনের জুলাই-গণ অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে রাখার কথা জানানো হয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকারি এ আবাসে দুই ডজনের বেশি কক্ষ আছে। নিচতলায় ছয়টি বেডরুম। দুটি বিশাল হলরুম। সেখানে সংবাদ সম্মেলন ও বৈঠক করতেন। তিনটি ড্রয়িং ও লিভিং রুম। এর সিলিংয়ে এখনো ঝুলছে ভাঙা ঝাড়বাতির অংশবিশেষ। দোতলায় সাতটি বেডরুম। ভবনের মূল নকশার বাইরে গিয়ে কাচে ঘেরা লিফট স্থাপন করা হয়েছে। দোতলার বেডরুমগুলোকে কলাপসিবল গেট দিয়ে সুরক্ষিত রাখা ছিল। মাঝে রাজকীয় সিঁড়ি। পশ্চিম এবং পূর্বেও সিঁড়ি। অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশাল ঘরগুলোর কাচভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে দিনে সূর্যের আলো ঢোকে।

দোতলার পূর্বে বড় একটি ড্রয়িং রুম। এ ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে বিশাল পুকুরটি দেখা যায়। এ পুকুরে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মাছ ধরতেন।

তবে তার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় কয়েক সহস্রাধিক মানুষকে হত্যার ঘটনায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে। সেসব অভিযোগ বিচারাধীন।

পূর্বদিকের দরজা দিয়ে মূল ভবনের ভিতরে ঢুকতেই ধুলায় ঢেকে থাকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অসংখ্য কাগজ, কাচ, সিরামিক, কাঠের টুকরা এবং ভাঙা আসবাবপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। মেঝের কোথাও কোথাও কুকুরছানার মল। আবার ঘরের কোথাও কোথাও মাকড়সার জাল। প্রতিটি দেয়ালে স্বৈরাচার ও আওয়ামী লীগবিরোধী নানা স্লোগান লেখা। শেখ হাসিনার বেডরুমের বাইরে বারান্দায় বেশ কিছু কাগজের মধ্যে একটি চোখে পড়ল। পড়ে থাকা কাগজগুলোর কয়েকটি পাতায় বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্য, কারা কারা সংশ্লিষ্ট এবং ঘটনা তদন্তে কী কী পাওয়া যায়নি তা উল্লেখ করা। করিডর পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে একটি কক্ষে পাওয়া গেল আরেকটি কাগজ। সেখানে পত্রিকার কাটিং থেকে বিভিন্ন হামলায় আহত-নিহত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের তালিকা করা। এ ছাড়া ২০১১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডিতে সাবেক সচিবদের নিয়ে করা বৈঠকের সারসংক্ষেপও পাওয়া গেছে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত সচিবরা তৎকালীন সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন তাও লিপিবদ্ধ করা। সরকারি নানা সংস্থায় নিয়োগ দিতে কয়েকজনের জীবনবৃত্তান্তও দেখা গেল।

ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া আরেকটি কাগজে ছয়জনের একটি তালিকা রয়েছে, যাদের ‘অর্থদাতা ও উসকানিদাতা’ হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

দক্ষিণ লাইনে মাঝে একটি কক্ষের ভিতরে গিয়ে মনে হলো এটিতে হয়তো থাকতেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। মেঝেতে এক কোণে মা, খালা এবং বোনের সঙ্গে থাকা জয়ের একটি ছবি পাওয়া গেল। পাশে বিটিসিএলের নানা প্রকল্পের একটি তালিকা এবং কাজের অগ্রগতির পরিমাণ লেখা একটি কাগজ ছিল। সেখানে বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প স্থাপনের একটি পরিকল্পনা প্রতিবেদনও ছিল। পাশের আরেকটি কক্ষের বারান্দায় পাওয়া গেল রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের ভিজিটিং কার্ড এবং পোষা প্রাণীর ভাঙা খাঁচা। এ ছাড়া বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা, ২০২৪ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তদের নামের তালিকা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের লিখিত বক্তৃতা এবং বাজেটের কাগজপত্রও দেখা গেছে। 

এ গণভবনে গত বছরের ৫ আগস্ট ব্যাপক লুটপাট হয়। নগদ অর্থ, আসবাব, ফ্রিজ থেকে শুরু করে শাড়ি, গয়না, দামি খাবার সবকিছু লুটপাট করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে অনেকে লুটের জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন। তবে এখনো অনেক কিছু ধ্বংসস্তূপ আর ধুলার মধ্যে পড়ে আছে। প্রতিটি কক্ষ ঘুরে চোখে পড়ে অসংখ্য গ্রাফিতি। এর মধ্যে একটা ‘আমার বাপের দেশ’, ‘জয় গণতন্ত্র-২০২৪’, ‘আমার তন্ত্র তোমার তন্ত্র গণতন্ত্র’, ‘ফেনীতে ছাত্র হত্যার বিচার করব’ ইত্যাদি।

ভবনের নিচতলায় বলরুম থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে বিভিন্ন আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার চিত্র দেখা গেল। তখন সেখানে এগুলোর তালিকা ও ছবি তুলে রাখছিলেন জাতীয় জাদুঘরের কর্মচারীরা। সেখানে দামি দামি ফ্রিজ, এসি, সোফা, স্ক্যানার মেশিন, আর্চওয়ে এবং পাওয়ার টিলার রাখা।

ভবনের মূল প্রবেশপথ দিয়ে বের হওয়ার সময় চোখে পড়ে একটি গ্রাফিতি। সাদা দেয়ালে লাল কালিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে একটি বার্তা লেখা। আরেক পাশে লেখা ‘হাসু আপা পালাইছে’। পশ্চিমের প্রবেশপথে ছাত্রলীগকে ইঙ্গিত করে একটি বার্তা লেখা। বাইরে দেয়ালে লেখা- ‘যেই আসবি চুরি করবি না’। বিপরীতে পড়ে রয়েছে একটি ডেন্টাল চেয়ার, একটি ম্যাসাজ চেয়ার আরেকটি ট্রেডমিল।

তবে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ চলছে বলে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার। জানা গেছে, বাংলাদেশে যত সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তাঁদের মধ্যে শুধু শেখ হাসিনাই গণভবনে বসবাস করেছেন। এ ছাড়া অন্য কোনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে বসবাস করেননি। যদিও নানাবিধ রাষ্ট্রীয় কাজে গণভবন ব্যবহৃত হয়েছে। শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি ১ টাকার বিনিময়ে গণভবন বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরও তিনি সেখানে বাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনা ২০০১ সালে গণভবন ছাড়তে বাধ্য হন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor