Trending

খরচের চাপে ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি সর্বনিম্ন ২৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা পঁয়ত্রিশ পয়সা বাড়ানোর চার মাসের মাথায় এবার ১০ শতাংশ পানির দাম বাড়িয়েছে

 ঢাকা ওয়াসা। এতে ঢাকায় বসবাস খরচ নতুন করে আরও এক ধাপ বাড়বে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের খরচ কমিয়ে কোনো রকমে সংসার চালানো নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর জুলাই থেকে বিদ্যুতের দাম আরও এক ধাপ বাড়বে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই জানান দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে নতুন করে আর কোনো কাটছাঁটের জায়গা না থাকায় তাদের অনেকেই এখন চেনা আবাস ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন; যেখানে কম টাকার বাসায় থাকতে পারবেন। কেউ বা আবার তিন রুমের বাসা ছেড়ে দুই রুমের কিংবা দুই রুম থেকে কমিয়ে এক রুমের সাবলেটে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন।

 ঢাকার ভাড়া বাসা ছাড়ার জন্য অন্তত দু’মাস আগে বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করার নিয়ম থাকায় ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর খবর জানার পরপরই অনেকেই এ ব্যাপারে তড়িঘড়ি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রাজধানী

 ঢাকার মুগদা, মাণ্ডা, সবুজবাগ, কদমতলা, যাত্রাবাড়ী, গোড়ান, রামপুরা, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ও আদাবরসহ নিম্নমধ্যবিত্তদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত এলাকার ভাড়াটিয়া এবং বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে। রামপুরার উলন এলাকার বাড়ির মালিক শাহিনা পারভীন জানান, তার দুই রুমের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে মাসে ১২শ’ এবং তিন রুমের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ১৫শ’ টাকা পানির বিল নিতেন। এতে কোনো কোনো মাসে প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার জন্য নিজের পকেট থেকে বাড়তি এক-দেড়শ’ টাকা যোগ করতে হতো। নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর কারণে প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে ফ্ল্যাটের আকার ভেদে আরও দুইশ’ থেকে চারশ’ টাকা বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন। এতে অপরাগতা প্রকাশ করে দুইজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

শাহিনা পারভীন বলেন, পানির বিল ১০ শতাংশ বাড়ার অর্থ আগে যে ভাড়াটিয়ার পানির বিল দেড় হাজার টাকা আসত, এখন এর সঙ্গে আরও দেড়শ’ টাকা যোগ হবে। এছাড়া  ঢাকা ওয়াসার পানির বিলের সমপরিমাণ যেহেতু সুয়্যারেজ বিল নেওয়া হয়, সেহেতু সেখানেও আরও দেড়শ’ টাকা বাড়বে। এ হিসাবে নতুন দরে ১৫শ’ টাকার পানি খরচ করলে ১৮শ’ টাকা বিল দিতে হবে।

নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য, অনেকের কাছে পানির এ বর্ধিত বিল আহামরি বড় কোনো অঙ্কের নয়। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ তাদের কাছে এটি ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’।

রাজধানীর মুগদার বাসিন্দা প্রাইভেট ফার্মের চাকরিজীবী সোহানুর রহমান জানান, তার কর্মস্থল মতিঝিলের দিলকুশায়। তার দুই সন্তান পড়াশোনা করে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। তাই তার অফিস ও সন্তানদের স্কুলের দূরত্ব বিবেচনায় রেখে প্রায় চার বছর ধরে উত্তর মুগদার দুই রুমের একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তবে উচ্চমূল্যের বাজারে সব দিক সামাল দেওয়া তার পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই গত কয়েক মাস ধরে তিনি ও তার দুই সন্তান রিকশার পরিবর্তে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করছেন। খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসা খাতের খরচও নানা কৌশলে কমিয়েছেন। অথচ এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিল বাড়ার কয়েক মাসের মধ্যে এবার পানির বিল বাড়ায় তিনি দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন।

সোহানুরের ভাষ্য, গত দু’বছরে বেতন এক টাকাও বাড়েনি। অথচ খরচ বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ। এ অবস্থায় নতুন করে বসাবসের বাড়তি খরচ চালানো তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই মুগদা থেকে সরে মাণ্ডা কিংবা মদিনাবাগ এলাকার দিকে বাসা খুঁজছেন। সেদিকে দেড়-দুই হাজার টাকা কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া গেলে সেখানেই তিনি উঠবেন। বুধবার পানির দাম বাড়ার খবর শোনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে বসবাস খরচ নতুন করে আরও বাড়ার আশঙ্কায় শুধু সোহানুরই নন, আরও অনেকেই বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, বিদ্যুৎ-পানি কিংবা গ্যাসের বিল ১০ শতাংশ বাড়লে বাড়িওয়ালারা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেন। চলমান টানাটানির সংসারে যা বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব।

মালিবাগের এবি গার্মেন্টের লাইন সুপারভাইজর মনিরুল ইসলাম জানান, গত তিন বছর ধরে খিলগাঁওয়ের গোড়ানে দুই রুমের একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকেন। আগে তার বিদ্যুৎ খরচ ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি মার্চে বিদ্যুৎ বিল বাড়ার পর তা এক ধাক্কায় দুই হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। পানির বিলও হয়তো একই হারে বাড়বে। সে হিসাবে বাড়িওয়ালা হয়তো কিছুদিন পরই দু’হাজার টাকা বাসা ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। তাই তিনি আগেভাগেই বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন। মেরাদিয়ার নামা এলাকায় কম ভাড়ায় বাসা পেলে পরিবার নিয়ে সেখানে থাকার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তবে বাজেটের মধ্যে বাসা না পেলে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এই গার্মেন্টকর্মী।

বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি গড়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৭০ পয়সা। এর মধ্যে বাসাবাড়িতে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী বা লাইফলাইন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৮ পয়সা। আগে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য তাদের খরচ করতে হতো চার টাকা ৩৫ পয়সা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে চার টাকা ৬৩ পয়সা। অর্থাৎ দাম সাড়ে ছয় শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এই শ্রেণির গ্রাহকরা সাধারণত বাসায় একটি ফ্যান ও দু’টি বাতি চালান এবং মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। এর ফলে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যহারকারী একজন লাইফলাইন গ্রাহকের আগে যেখানে মাসে নিট বিল আসত ২১৭ টাকা ৫০ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে বিল আসবে ২৩১ টাকা ৫০ পয়সা।

গ্রাহকদের মধ্যে যাদের বাসায় একাধিক বাতি, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ এবং একটি এসি রয়েছে, তারা সাধারণত ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৫৭ পয়সা। ফলে এখন থেকে মাসে তাদের প্রায় একশ টাকা বেশি বিল গুনতে হতে পারে। আগে এই শ্রেণিতে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ছিল ছয় টাকা ৬৩ পয়সা। এখন সেটি বাড়িয়ে প্রতি ইউনিটের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সাত টাকা ২০ পয়সা। এছাড়া গ্রাহকদের মধ্যে অনেকেরই বিদ্যুতের ব্যবহার ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের মধ্যে হয়ে থাকে। তাদের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য ছয় টাকা ৯৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৫৯ পয়সা করা হয়েছে।

অন্যদিকে আবাসিকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের। মূলত বিত্তবানরাই এই শ্রেণির গ্রাহক। তাদের জন্য ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতে দাম সর্বোচ্চ এক টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে প্রতি ইউনিটের জন্য তাদের মূল্য দিতে হতো ১৩ টাকা ২৬ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা ৬১ পয়সা। ফলে আগে ৬৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে যেখানে বিল আসত ৮ হাজার ৬১৯ টাকা, এখন সেখানে বিল দিতে হবে ৯ হাজার ৪৯৬ টাকার মতো।

এ হিসাবে বিত্তশালীদের বিদ্যুৎ খরচ উচ্চ হারে বাড়লেও নিম্নমধ্যবিত্তদের তা সহনীয় পর্যায়েই রয়েছে। তবে গত কয়েক মাস ধরে মাত্রাতিরিক্ত গরম পড়ায় অনেকের বিদ্যুৎ খরচ আগের তুলনায় বেশ কিছুটা বাড়তে পারে।

তবে কাগজে-কলমে নিম্নমধ্যবিত্তদের বিদ্যুৎ বিল সামান্য বাড়ার কথা থাকলেও বাস্তবে যে তা হচ্ছে না তা অনেকের সঙ্গে কথা বলেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ করা হয় যেসব কেন্দ্র থেকে তারাও নিঃসংকোচে তা স্বীকার করেছেন। বরিশাল টেলিকমের রিচার্জ পারসন মোকসেদ আলী জানান, আগে যেসব গ্রাহক মাসে এক হাজার টাকা রিচার্জ করতেন, তারা এখন মাসে দেড় হাজার টাকা রিচার্জ করছেন। আগে দুই হাজার টাকা রিচার্জ করা গ্রাহকরা আড়াই হাজার টাকা রিচার্জ করেও পুরো মাস চালাতে পারছেন না। এ নিয়ে তারা তাদের কাছে নানা প্রশ্ন করছেন। কিন্তু তাদের কাছে এর কোনো সদুত্তর নেই।

এদিকে বিদ্যুতের মতো ওয়াসার বিলের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ভেলকিবাজির খেলা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ারা অনেকেই।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী গত ১৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ছয় গুণের বেশি, যা শতাংশ হিসাবে দাঁড়ায় ৬২৮। এছাড়া গত ২৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।

সংগঠনটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে,

 ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা বাসাভাড়া পরিশোধে ব্যয় করেন।

এ পরিস্থিতিতে বসবাস খরচ গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়লে তা অনেকের পক্ষেই বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার গ্রামের পথে পা বাড়াবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button