খরচের চাপে থেমে যায় চিকিৎসা
বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত শিল্পী সাফানা মেহরিন। ২০০০ সালে তার কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। ২০০২-০৩ সালে টানা ১৭ মাস ডায়ালাইসিস করতে হয়। এরপর তিনি ভারতের মাদ্রাজে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে যান। এতে তার বাবার প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। এরপর বিয়ে হয় বেসরকারি চাকরিজীবী আনোয়ারের সঙ্গে। আনোয়ার-সাফানা দম্পতির জীবন সুখেই চলছিল। ২০০৯ সালে সাফানা সন্তান নেন। চিকিৎসকরা তাকে বারণ করলেও তিনি ঝুঁকি নিয়ে একমাত্র সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। কিন্তু অদৃশ্যের পরিহাস কিংবা বিধি বাম, সন্তান নেওয়ার চার বছরের মাথায় ২০১৩ সাল থেকে তার কিডনিতে সমস্যা ফিরে আসে। পুনরায় শুরু হয় তার ডায়ালাইসিসযুদ্ধ। কিডনি রোগ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে তার জীবন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। চিকিৎসা চালানোর মতো অবস্থা তার আর নেই।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় সাফানা মেহরিনের। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিডনি চিকিৎসা, ট্রান্সপ্লান্ট ও ডায়ালাইসিস করতে করতে আজ আমি ও আমার পরিবার নিঃস্ব। এই চিকিৎসা চালাতে গিয়ে তিন বিঘা জমি বিক্রি করেছি, দোকান বিক্রি করেছি। এখন আমার হাতে আর কিছুই নেই। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক।’
সাফানা মেহরিন বলেন, ‘সপ্তাহে তিনটি ডায়ালাইসিস নিতে হয় আমাকে। প্রতিটি ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ৪ হাজার টাকা করে। হিমোগ্লোবিন ইনজেকশন সপ্তাহে একটি নিতে হয়, যার দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা। মাসে ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ এবং সঙ্গে পরিবহন খরচ তো আছেই।’
এটা সাফানা মেহরিনের গল্পই শুধু নয়, দেশের কিডনি রোগে আক্রান্ত ৪ কোটি রোগীর গল্প। কিডনি রোগের প্রকোপ ব্যাপক, এই রোগের মারাত্মক পরিণতি, অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগীই মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এতে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। দেশে প্রচলিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা হচ্ছে কিডনির। কিডনি রোগের শেষ পরিণতি কিডনি বিকল। একবার কিডনি বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। কিন্তু কিডনি সংযোজন কিংবা ডায়ালাইসিস দুটিই ব্যয়বহুল চিকিৎসা। ফলে এই রোগে আক্রান্তদের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয়।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ১৯ হাজার ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০৪০ সালে মৃতের সংখ্যা বেড়ে বছরে ৪৪ হাজার ২৫০ হবে। কিডনি ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজারের মতো রোগীর কিডনি পুরোপুরি বিকল হচ্ছে। আর্থিক সংকটের কারণে ৬ মাস পরে বেশিরভাগ লোকই আর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না।
২০০০ সাল থেকে দেশে কিডনি নিয়ে কাজ করছেন কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। তার একটি পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে কিডনি রোগীদের অসহায়ত্বের কথা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, কিডনি বিকল হয়ে গেলে তা প্রতিস্থাপন অথবা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। কিডনি প্রতিস্থাপন নানা কারণে দেশে কম হয়। সরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে খরচ হয় ৪-৬ লাখ টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালে খরচ হয় ১০-১৫ লাখ টাকা। বছরে যেখানে কিডনি বিকল হয় ৪০ হাজারের বেশি মানুষের, সেখানে এখন পর্যন্ত দেশে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে আড়াই হাজারের কাছাকাছি।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, এই রোগীদের ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয়। সরকারি পর্যায়ে দেশে মাত্র ৩০-৩৫টি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে, ফলে এই সুবিধা খুব কম রোগী পেয়ে থাকে। এসব সেন্টারে প্রতিটি ডায়ালাইসিসে খরচ হয় হাজার টাকার মতো। একজন রোগীকে সপ্তাহে ৩টি করে মাসে ১২টি ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এতে খরচ হয় ১২ হাজার টাকা, সঙ্গে ওষুধ ও যাতায়াত মিলে আরও ২০ হাজার টাকা। এতে তার মাসে খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা এবং বছরে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। আবার বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। এতে একজন রোগীকে ১২টি ডায়ালাইসিসে মাসে সর্বনিম্ন ৪৮ হাজার এবং সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হয়। বছরে সর্বনিম্ন ৬ লাখ ও সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়, এর সঙ্গে ওষুধ, ডাক্তার ফি ও যাতায়াত খরচ আছে।
তিনি বলেন, ‘আমার চিকিৎসাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বেশিরভাগ রোগীই ছয় মাসের বেশি চিকিৎসার খরচ চালাতে পারেন না। এসব রোগী বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। আরেক ধরনের রোগী আছেন যারা সমস্যা বেশি হলে টাকা-পয়সা জোগাড় করে চিকিৎসা করাতে আসেন এবং কিছুদিন পর চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। আর অল্প কিছু রোগীকে পেয়েছি যারা পুরোপুরি চিকিৎসার আওতায় থাকেন। এই রোগীদের অধিকাংশ পরিবার আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল থাকলেও চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার তাসলিমা ফেরদৌস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা এই শিক্ষার্থী ২০১৬ সালের অক্টোবরে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে সিজারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সিজারের জায়গায় অধিক রক্ত করণ হয়। ফলে তার দুটি কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে তাকে একটানা তিন মাস বিভিন্ন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট ভেন্টিলেটরে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। একপর্যায়ে তাকে ভারতের ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার চিকিৎসায় বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে একটানা দুই বছর ডায়ালাইসিস করতে হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের একটি হাসপাতালে তার একটা কিডনি প্রতিস্থাপন করানো হয়।
তাসলিমা ফেরদৌস দেশ রূপান্তরকে বলেন, দিল্লিতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও চিকিৎসায় প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এখানেই শেষ নয়, মাসে আমাকে ১৫-২০ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমার শরীরের প্রতিস্থাপিত কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। চিকিৎসক আমাকে আবার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে বলছেন। এখন আমার আর সেই সামর্থ্য কোথায়।
মিরপুরের বাসিন্দা শহিদুল আলম বেসরকারি চাকরিজীবী। ছয় মাস আগে পরীক্ষায় তার কিডনি বিকল ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করতে বলেছেন। প্রতি মাসে ডায়ালাইসিস ও চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে তার সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে অসুস্থতার কারণে লাগাতার অনুপস্থিতির কারণে তার চাকরিও চলে গেছে। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে কত দিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার মতিহার মিয়া তিন মাস আগে কিডনি রোগে মারা যান। তার ছেলে আল আমিন বলেন, ‘তিন বছর আগে আব্বার একটা কিডনি বিকল হয়। বয়সের কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে পারিনি। প্রথম এক বছর তার চিকিৎসা পুরোদমে চলে, এতে জায়গা জমি বিক্রি করতে হয়। এরপর থেকে তার চিকিৎসা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কখনো সপ্তাহে একটি ডায়ালাইসিস দেওয়া হতো, এরপর তা মাসে একবার করে, টাকা জমাতে না পেরে মৃত্যুর আগে তার চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হই।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কিডনি রোগের যে ব্যয় তা সাধারণ মানুষের পক্ষে মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অধিকাংশ রোগীই ব্যয় মেটাতে না পেরে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। যারা চিকিৎসা চালিয়ে যান, তারাও জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে ফেলেন। আমাদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে কিডনি রোগ বাড়ছে। সচেতনতা বাড়াতে হবে।’