Trending

খরতাপে পুড়ছে শহর-গ্রাম

টানা তাপপ্রবাহের কবলে ৪৫ জেলা : আরো ছড়িয়ে পড়ার পূর্বাভাস : হিট এলার্ট অব্যাহত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাবনায় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি :: প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে লোডশেডিংয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা : হিটশকের ঝুঁকিতে ফল-ফসল : হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই

বৈশাখী প্রখর রোদের তেজে তীব্র গা-জ্বলা খরতাপে পুড়ছে শহর-বন্দর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ। গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল পাবনার ঈশ^রদীতে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উচ্চ তাপদহনে পুড়ছে ফল-ফলাদির বাগ-বাগিচা, অনেক জেলা-উপজেলায় আধাপাকা ইরি-বোরো ফসল, সবজি ক্ষেত-খামার। টানা উচ্চতাপে ফল-ফসলের কমবেশি ক্ষতি হচ্ছে হিটশকে। অবিরাম ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক তাপমাত্রা চলতে থাকলে ফসলে হিটশকে ধান চিটায় নষ্ট হয়। ফল-ফলাদির গুটি শুকিয়ে ঝরে যায়। তীব্র গরমে ও খরা-অনাবৃষ্টিতে ফল-ফসল হিটশকের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় ফসলি জমিতে সেচ দিয়ে দুয়েক ইঞ্চি পরিমাণ পানি রাখার এবং আম, লিচু, জামসহ ফল গাছে পানি ছিটানোর পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। উচ্চতাপে শহর-নগর-গ্রাম-শিল্পাঞ্চলে প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। তাছাড়া সর্দি-কাশি, জ¦র-ডায়রিয়া, শ^াসকষ্টসহ নানাবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডাক্তারের চেম্বারে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর ভিড়।

তীব্র গরমের সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবনে দুঃসহ যন্ত্রণা বিরাজ করছে। উচ্চ তাপদাহে কৃষক, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা, ঠেলা ও ভ্যান চালকসহ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা রুজি-রোজগারে কঠিন সঙ্কটে পড়েছে। তাদের কাজ ও আয় কমে গেছে। অনেকেই রোদের আগুনে পুড়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মাঠে-ঘাটে-বিলে কাজকর্ম করতে গিয়ে।

গতকাল পাবনায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সে.) ছাড়াও উল্লেখযোগ্য উচ্চ তাপমাত্রা ছিলÑ খুলনা ও যশোরে ৪০.৪, রাজশাহী ও পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ৪০.২, মোংলায় ৪০, গোপালগঞ্জে ৩৯.৮, দিনাজপুর ও চুয়াডাঙ্গায় ৩৯.৬, কুষ্টিয়ায় ৩৯.৫ ডিগ্রি সে.। রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৩৮.৪ এবং সর্বনিম্ন ২৮.২ ডিগ্রি সে.।

রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে তাপপ্রবাহ মৃদু থেকে মাঝারি ও তীব্র আকারে বয়ে যাচ্ছে। এসব বিভাগের অন্তত ৪৫টি জেলার উপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
চলমান তাপপ্রবাহ দেশের অন্যান্য জায়গায় আরো ছড়িয়ে পড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। সোমবার জারিকৃত তিন দিনের হিট এলার্ট অব্যাহত রয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও পটুয়াখালী জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, বান্দরবান জেলাসহ ঢাকা, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ এবং রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারী ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ আরো বিস্তার লাভ করতে পারে। আজ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।

সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের অধিক থাকার কারণে গরমে-ঘামের কষ্ট ও অস্বস্তি অব্যাহত আছে। গতকাল রাজধানী ঢাকায় বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা অর্থাৎ জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ছিল সকালে ৯২ শতাংশ এবং সন্ধ্যায় ৩৯ শতাংশ।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও ছিঁটেফোঁটাও বৃষ্টিপাত হয়নি। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ‘যদি’ হঠাৎ মাঝেমধ্যে কোথাও বজ্র-শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড় হয়, তখন সেখানে স্থানীয়ভাবে ক্ষণিকের বৃষ্টিপাত হলেই কেবল সাময়িক স্বস্তি আসতে পারে।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার (দুই দিন) আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা আরো কিছুটা বৃদ্ধি এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বিরাজ করবে।

আগামী শুক্রবারের পূর্বাভাস : অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের জন্য গরমে-ঘামে অস্বস্তি বিরাজ করবে।

এর পরের ৫ দিনে আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।
কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপদাহে জনজীবনে নাভিশ্বাস : এদিকে কুষ্টিয়া থেকে বিশেষ সংবাদদাতা জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। আগামী কয়েক দিনেও তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে পেটের দায়ে কাজে নামছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। গরমজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। তীব্র গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে নগরজীবনে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষ। উচ্চবিত্তের অনেকে প্রয়োজন ছাড়া দুপুরবেলা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

এদিকে, কুষ্টিয়া জেলাজুড়ে অব্যাহত রয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে গরমজনিত ও পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। বৈশাখে এমন তাপপ্রবাহের কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না মানুষ। ভ্যাপসা গরম বাতাসে মানুষের শরীর পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের তাপে গরম অনুভূত হচ্ছে। বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা। বিশেষ করে ভ্যান, রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক, কৃষক, দিনমজুরদের অবস্থা শোচনীয়।

শনিবার কুষ্টিয়া জেলায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি এ যাবৎকালের কুষ্টিয়ার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার কুষ্টিয়া জেলায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে শুক্রবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার সুলতানপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, এই গরমে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। আগে কখনও আমার এই জেলাতে এমন তাপপ্রবাহ দেখিনি। প্রচণ্ড গরমে খেটে খাওয়া মানুষজন চরম কষ্টে রয়েছে। কৃষকরা মাঠে গিয়ে কাজ করতে পারছেন না। রাস্তায় লোকজন না থাকায় ভ্যানচালকসহ দারিদ্রসীমার নিচে যাদের চলাচল সবাই বিপাকে আছেন। আল্লাহ যেন বৃষ্টি দিয়ে এই তাপপ্রবাহ থেকে কুষ্টিয়াবাসীকে রক্ষা করেন, সেই দোয়া করছি।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তবে শঙ্কার কথা, আমরা সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। এটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদী কিংবা খাল বিলের পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের চরম বিপাকে পড়তে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য আমাদেরই দায়ী থাকতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button