Hot

খাদ্যের বাড়তি দাম নিয়ে ৭১% পরিবারে উদ্বেগ

প্রতিবেদনে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হারের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশকে চারটি শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ‘লাল’ শ্রেণিতে।

খাদ্যের বাড়তে থাকা দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে এক বছর ধরেই খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান।

‘খাদ্যনিরাপত্তা’ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক নিয়মিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় গত ডিসেম্বর মাসে।

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হারের ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে চারটি শ্রেণিতে রেখেছে। বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাদ্যের মূল্যস্ফীতি শ্রেণিতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ হিসাবে (অক্টোবর–নভেম্বর) প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ভুটান ও নেপালে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম ছিল। অনেক বেশি ছিল পাকিস্তানে।

খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়ে গেলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। গত বছর শুরুর দিকে আমরা একটি গবেষণা করেছিলাম; তখন দেখেছি, দেশের নিম্ন আয়ের ৭০ শতাংশ পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান

সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করে দেখা যায়, প্রায় ২ কোটি ৯১ লাখ পরিবারের জন্য খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়ে গেলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। গত বছর শুরুর দিকে আমরা একটি গবেষণা করেছিলাম; তখন দেখেছি, দেশের নিম্ন আয়ের ৭০ শতাংশ পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।’

বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে খাদ্যশস্য আমদানি (আমদানি বিল পরিশোধ বিবেচনায়) ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। শস্য নয়, এমন খাদ্যপণ্য আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।

যা আছে প্রতিবেদনে

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছুটা পিছিয়ে আছে। সরকার আপৎকালীন মজুত করছে। ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর দেশে আপৎকালীন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) মজুতের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৮ লাখ টন, যা গত জুনে ছিল ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন। সরকার লক্ষ্যের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি চাল সংগ্রহ করেছে।

বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে খাদ্যশস্য আমদানি (আমদানি বিল পরিশোধ বিবেচনায়) ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। শস্য নয়, এমন খাদ্যপণ্য আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।

চালের দাম এক বছর ধরে প্রায় স্থিতিশীল আছে বলে উল্লেখ করা হয় বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। আরও জানানো হয় যে গত এপ্রিল মাস থেকে সরু চালের দাম কমেছে।

বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও সেটি রয়েছে উচ্চমূল্যে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাজারে মোটা চালের প্রতি কেজির দর ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। মোটা চালের দাম এরপর থেকে বাড়তে বাড়তে ৫০ টাকার আশপাশে ওঠে। সেটা আর তেমন কমেনি। এখন মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা।

টিসিবির তথ্যে আরও দেখা যায়, ওই সময় বাজারে খোলা আটার প্রতি কেজির দর ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। একইভাবে অনেকটাই বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। যেমন মোটা দানার মসুর ডালের দাম ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এখন ১০৫ থেকে ১১০ টাকা।

মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল করোনাকালের শুরুতে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যসহ বেশির ভাগ পণ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে মার্কিন ডলারের দাম, যা পণ্য আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেয়।

টিসিবির তথ্যে আরও দেখা যায়, ওই সময় বাজারে খোলা আটার প্রতি কেজির দর ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। একইভাবে অনেকটাই বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। যেমন মোটা দানার মসুর ডালের দাম ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এখন ১০৫ থেকে ১১০ টাকা।

২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশির ভাগ সময় মাছ, মাংস, সবজি এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়তি ছিল। সরকারও জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়িয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটি কমে এলেও ডলারের দাম কমছে না। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমদানি করা পণ্যের দাম খুব বেশি কমবে বলে মনে হয় না।

 ‘লাল’ শ্রেণিতে বাংলাদেশ

খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কতটা বেশি, তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চার শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। যেসব দেশের খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা এর বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’; ৫-৩০ শতাংশের মধ্যে হলে ‘লাল’; ২-৫ শতাংশের মধ্যে হলে ‘হলুদ’ এবং ২ শতাংশের কম খাদ্যের মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ২০২৩ সালজুড়েই (নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব) ‘লাল’ শ্রেণিতে ছিল। এ শ্রেণিতে বাংলাদেশের সঙ্গী ৭১টি দেশ, যার মধ্যে রয়েছে উগান্ডা, লাওস, মিশর, হন্ডুরাস, কেনিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি অনেকটাই কমেছে। উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে গত বছর সাড়ে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। তবে গত জুলাই থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়েনি; বরং মূল্য সংকুচিত হচ্ছে। অর্থাৎ, গত বছর যে দাম ছিল, তার চেয়ে কমেছে। নভেম্বরে শ্রীলঙ্কায় খাদ্যমূল্য সংকুচিত হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছর খাদ্য কিনতে ১০০ রুপি ব্যয় হলে, এবার লাগছে ৯৬ দশমিক ৪০ রুপি।

ধনী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও খাদ্যের মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমিয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাদের খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি, যা গত নভেম্বরে ৩ শতাংশের নিচে নামে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে নভেম্বরে সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু খাদ্যের মূল্যস্ফীতি নয়; সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। গত মার্চ মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি ছিল।

সরকার নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের ভর্তুকি মূল্যে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ দেয়। এটা দেওয়া হয় মাসে একবার, পরিমাণ এক থেকে দুই কেজি করে। খোলাবাজারে কম দামে চাল ও আটা বিক্রি করা হয়। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানো দরকার। কারণ, স্বল্প আয় ও নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবার এ সুবিধার বাইরে রয়েছে।

রাজধানীর একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করেন মিরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। দুই ছেলে, স্ত্রীসহ চারজনের সংসার তাঁর। বছর দুয়েক আগেও স্বাচ্ছন্দে৵র সঙ্গেই সংসার চালাতেন তিনি। কিছু সঞ্চয়ও করতে পারতেন। তিনি বলেন, এক-দেড় বছর ধরে সঞ্চয় করতে পারেন না; বরং খাবারের ব্যয়ে কাটছাঁট করতে হয়েছে।

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, সংসারের ব্যয় ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে; কিন্তু আয় তো সেভাবে বাড়েনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button