খাবার কেনার সামর্থ্য থাকবে না পৌনে দুই কোটি মানুষের
সামনের দিনে সাইক্লোন প্রভৃতি বড় জলবায়ু দুর্যোগের শঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের। এ কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে; খাদ্যদ্রব্যের এখনই উচ্চমূল্য, এটি আরও বাড়তে পারে। অর্থনীতিতে এখন যে সংকট রয়েছে, তাতে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের খাদ্যের জোগান আরও কঠিন হবে।
চলতি বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়ে দেশের ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি পেজ ক্ল্যাসিফিকেশন আইপিসি। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এ-বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তারা জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (এফএও) সঙ্গে যৌথভাবে সারা বিশে^ করে।
সংস্থাটি বলছে, এপ্রিল-অক্টোবর সময়ে খাদ্য কেনা নিয়ে চাপে থাকবে ২ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ, খাদ্যসংকটে পড়বে ১ কোটি ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ। তীব্র সংকটে পড়বে ৭ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বাইরে বা নিরাপদ অবস্থানে থাকবে ২ কোটি ৯২ লাখ ৫১ হাজার মানুষ।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের হিসাবও দেওয়া হয়েছে। এ দুই মাসে খাদ্য নিয়ে চাপে ছিল ২ কোটি ৭৮ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। খাদ্যসংকটে পড়েছিল ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছিল ৩ লাখ ২৮ হাজার মানুষ। আইপিসি পূর্বাভাস মনে রেখে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে না পারলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ারই আশঙ্কা। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো বলছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি উৎপাদনের যে হিসাব দিচ্ছে, তাতে ভরসা করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের খাদ্যসংকট নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, তখনই যখন বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ভালো। উৎপাদন ভালো হলেও চালের দাম কমবে বলে মনে হয় না, ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেই খাদ্যসংকট থেকে যাবে।
বাংলাদেশের উৎপাদন ও আমদানি যে বাড়বে সে কথাও বলেছে আইপিসি। তারা বলেছে, আগামী অক্টোবর নাগাদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান ফসল আমদানি (গম ও চাল) করা হবে। বেসরকারি খাতে গম আমদানি চলবে জুন পর্যন্ত। ধানের ফলন হতে পারে ৪ কোটি ১০ লাখ টনের বেশি, যা গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। গমের ফলন একই রকম থাকবে (১১ লাখ টন)। ভুট্টার ফলন ৫০ লাখ টন বা বেশি হতে পারে (গড়ের বেশি)।
কেন খাদ্যসংকট?
আইপিসি বলছে, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এপ্রিল-অক্টোবরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। বর্ধমান উচ্চ খাদ্যমূল্য ও জলবায়ুঘটিত কারণে এ সময়ে গৃহস্থালির খাদ্য জোগান পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ফলে বেশিরভাগ খাদ্যনিরাপত্তাহীন মানুষ আরও ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনটি চলকের কারণে বাংলাদেশে খাদ্যসংকট তৈরি হতে পারে। প্রথমত, ২০২৩ সালের মার্চের পর থেকে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশের বেশি। দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাবার কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ধাক্কার কারণে বেশিরভাগ জেলায় পরিবারগুলোর প্রধান দুর্বলতা আয় কমে যাওয়া, উচ্চ জ্বালানি ও পরিবহন খরচসহ আরও কিছু বিষয়।
তৃতীয়ত, ২০২৩ সালে তিনটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। আকস্মিক বন্যা দেখা দেয় ও পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধস ঘটে; ফলে ফসল, গবাদি পশু ও মাছ চাষে বড় সংকট তৈরি হয়। ২০২৪ সালেও এলনিনোর কারণে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা রয়েছে।
আসন্ন সংকটে কী করণীয় এমন প্রশ্নের জবাবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উদ্ধার করা জরুরি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি।’
প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে যা বলছে, তা হয়েছে মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমে গেছে বলে। চালের দাম ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর আগে বিবিএসের এসভিআরএস জরিপেও বলা হয়েছে, ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ৭০ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এগুলো সবই একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত।’
ড. মোস্তাফিজ বলেন, ‘এখন কাজ হচ্ছে মানুষের আয় বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করা। তাতে পরিস্থিতি হয়তো সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা জরুরি। রপ্তানি বাড়ানো ও আমদানির ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, তা দূর করতে হবে। উৎপাদনের নেতিবাচক দিকগুলোও দূর করতে হবে। মোদ্দাকথা, অর্থনৈতিক উৎকর্ষতা নিশ্চিত করতে হবে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরও ভালো করতে হবে।
যেভাবে জরিপ
কয়েকটি ধাপে মানুষের সংকটকে বিশ্লেষণ করেছে আইপিসি। ফেজ-১ বলতে বোঝায় ন্যূনতম খাদ্য নিরাপত্তা, ফেজ-২ খাদ্য নিয়ে চাপে আছে এমন জনগোষ্ঠী, ফেজ-৩ খাদ্য নিয়ে সংকটে আছে এমন জনগোষ্ঠী, ফেজ-৪ তীব্র সংকটে আছে এমন জনগোষ্ঠী, ফেজ-৫ দুর্ভিক্ষে থাকা জনগোষ্ঠী।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর সময়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ (বিশ্লেষিত জনসংখ্যার ২২ শতাংশ) আইপিসি ফেজ-৩ বা তার ওপরে থাকবে, ৮ লাখ লোক আইপিসি ফেজ-৪-এ থাকতে পারে। পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, মানিকগঞ্জ ও শরীয়তপুরের মতো জেলা আইপিসি ফেজ-২ (মোটামুটি চাপ) থেকে আইপিসি ফেজ-৩-এ (সংকট) পরিবর্তিত হতে পারে। কক্সবাজারের এফডিএমএন (মিয়ানমার থেকে জোর-পূর্বক কক্সবাজারে পাঠানো জনগোষ্ঠী) জনসংখ্যার ফেজ-৩ থেকে ফেজ-৪-এ যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বড় খাদ্যসংকট উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বেশি হতে পারে। সবচেয়ে বেশি হতে পারে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায়। ফলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার দুর্বল ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা আগামী মাসগুলোতে কঠিন হয়ে উঠবে।
এখন মূলত ফসল কাটার মৌসুম। এ মৌসুমেও বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ মানুষ উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ এ দুই মাসে সবচেয়ে বেশি খাদ্যসংকটে ছিল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী (৪৫ শতাংশ), ভাসানচর (৩০ শতাংশ), সুনামগঞ্জ (৩৫ শতাংশ) ও বান্দরবান (৩৫ শতাংশ)। রাঙ্গামাটি (৩০ শতাংশ), কুড়িগ্রাম (৩০ শতাংশ) ও কক্সবাজার জেলা (৩০ শতাংশ)।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান, ভূসংস্থান ও জলবায়ুর কারণে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে সংবেদনশীল দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে পিছিয়ে পড়ছে।
আগামী মে ও আগস্ট মাসের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যা আরও সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইপিসি। উপকূলীয় জনগোষ্ঠী গত বছরের ভারী বর্ষা, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত এ জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে।
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। অক্টোবর নাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা ২৯টিতে উন্নীত হতে পারে।
জলবায়ুতে বাংলাদেশের শঙ্কা এত বেশি কেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত, উৎপাদন সক্ষমতা অর্থাৎ দেশটি কতটুকু উৎপাদন করতে পারছে। দেশের চাহিদা কতটুকু, খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা কেমন প্রভৃতি। জলবায়ু পরিবর্তন তো বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত না। এটির সম্পর্ক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা দেশের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। কোন জেলায় কতটুকু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে তা দেখার বিষয়। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কৃষি ঝুঁকির মধ্যে আছে।’
ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এ কথা সত্যি। আমরা এ পরিবর্তনের জন্য যে দায়ী না, সেটিও সত্যি। আমাদের নানাভাবে যে ভয় দেখানো হচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো তেমন সংকটে পড়েনি যে বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে।’
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু ঝুঁকির শীর্ষ পাঁচের মধ্যে বাংলাদেশ। তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, আবার বৈশি^ক যে আলোচনা আছে, তাতেও সক্রিয় অংশগ্রহণ রাখতে হবে। আমাদের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বনায়ন কর্মসূচি ঢিলেঢালাভাবে হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় কৃষি উৎপাদন জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটাও দেখতে হবে।’
জলবায়ুর নেতিবাচক অভিঘাতও আমাদের কমাতে হবে, বিপরীতে জলবায়ু সহিষ্ণু পদ্ধতিগুলো বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কয়েকটি শঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি উচ্চ থাকবে বা সামান্য পরিবর্তিত হবে। জ্বালানি ও সারের ভর্তুকি পরিবর্তন করা না হলে মৌসুমি প্রবণতা অনুসারে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বর্তমান হার থেকে কমবে। জুন-সেপ্টেম্বরে চাল/শস্যের দাম ধীরে ধীরে বাড়বে। সারের দাম নিয়ন্ত্রিত, তাই এত বড় পরিবর্তন আশা করা যায় না।
আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত আগামী মাসে গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এটি অতিরিক্ত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কারণ বাংলাদেশে আরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটাতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি (মধ্যপ্রাচ্যে, ইউক্রেন-রাশিয়া) ঘটলে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে।