International

খেটে খাওয়া পরিবার থেকে উঠে আসা কিয়ার স্টারমার ধরলেন যুক্তরাজ্যের হাল

তিন বছর আগে লেবার পার্টির প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার কথা গুরুত্বের সঙ্গেই ভেবেছিলেন কিয়ার স্টারমার। সময়টা ছিল ২০২১ সাল। ওই সময় তাঁর দল বরিস জনসন নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টির কাছে হার্টলপুল উপনির্বাচনে হেরে যায়। তখনই প্রথম ওই আসন লেবার পার্টির হাত ছাড়া হয়। এরপরের তিন বছর এখন স্টারমারের কাছে পুরো রাজনৈতিক জীবন মনে হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে কিয়ার স্টারমার দলকে বিরোধী দলের আসন থেকে ক্ষমতায় নিলেন। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়া লেবার পার্টি ২০২৪ সালে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করল। তবে ডাউনিং স্ট্রিটের পথে স্টারমারের যাত্রা যে সহজ ছিল না, তা হার্টলপুল উপনির্বাচনের ফলাফল মনে করিয়ে দেয়।

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও তাঁর স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। আজ শুক্রবার লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও তাঁর স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। আজ শুক্রবার লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে

প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকাল তাঁর জীবন ও কাজ ছিল একেবারে ভিন্ন ধারায়। বাবা-মায়ের চার সন্তানের একজন কিয়ার স্টারমার। কেন্ট ও সারের সীমান্তবর্তী অক্সটেড শহরে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন যন্ত্রাংশ নির্মাতা, মা ছিলেন নার্স। ১৯৭০–এর দশকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালে বেড়ে ওঠার সময়কার চ্যালেঞ্জগুলো নিজেই বলেছেন কিয়ার স্টারমার। এক নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি শ্রমজীবী ​​হন, আপনি ঋণকে ভয় পাবেন। আমার মা–বাবাও ঋণ ভয় পেতেন।’

কিয়ার স্টারমার তাঁর ছোটবেলা থেকে অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। তিনি মাঝমাঠে ‘সেন্টার লেফট’ হিসেবে খেলতেন। এ ছাড়া তিনি মেধাবী সংগীতশিল্পী ছিলেন। ভায়োলিন বাজানোও শিখেছিলেন।

কিয়ার স্টারমারের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা একবার নগদ অর্থ সংগ্রহের জন্য ফ্রান্সের সমুদ্রসৈকতে অবৈধভাবে আইসক্রিম বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন।

কিন্তু এ সময় তাঁর জীবনে রাজনীতি কই? কিন্তু সব সময় এর একটি সূত্র তাঁর সঙ্গেই ছিল। আর সেটি হলো তাঁর নাম। লেবার পার্টির প্রথম নেতা কিয়ার হার্ডির নাম অনুসারে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল। কিয়ার স্টারমার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এটা শুরু হয়েছিল স্টারমারের স্কুলজীবন থেকে। তখন তিনি লেবার পার্টির তরুণদের শাখা ‘ইয়াং সোশ্যালিস্ট’–এ যোগ দেন। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে স্কুলজীবন পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর। তিনি প্রথমে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

নির্বাচনে লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন  দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার। এ সময় রাজা তাঁকে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান

নির্বাচনে লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার। এ সময় রাজা তাঁকে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান

লিডসে পড়ার সময় তিনি আশির দশকের ‘ইন্ডি মিউজিক’–এ প্রভাবিত হন। তাঁর জীবনী লেখক টম বাল্ডউইন লিখেছেন, স্কুলজীবন থেকে তাঁর প্রিয় পানীয় ছিল বিয়ার ও সাইডারের মিশ্রণ বা স্নেকবাইট। এ ছাড়া তিনি তরকারি ও চিপস পছন্দ করতেন।

স্নাতক শেষ করার পর কিয়ার স্টারমার উত্তর লন্ডনের একটি পতিতালয়ের ওপরে বাসা নিয়ে থাকতেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ, তিনি একজন কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান (ওয়ার্কহোলিক) হিসেবে খ্যাতি অর্জন করছিলেন, যা তাঁকে সফল ও একজন খ্যাতিমান মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এ সময় রাজনীতি তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। পরবর্তী দুই দশক তিনি আইন পেশায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন। ২০০৮ সালে তিনি পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক হন। পদটি ছিল ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রধান কৌঁসুলির। জীবনের এ পর্বকে জনগণের সেবায় নিজের নিবেদনের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন কিয়ার স্টারমার। এ সময় সন্ত্রাসী গ্যাংগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে তাঁর ভূমিকার কথা তিনি প্রায়ই বলে থাকেন।
২০১০ থেকে ২০১৫ সালের জোট সরকারের সময় ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের বাজেট এক–চতুর্থাংশ কমানো হয়। এতে কিয়ার স্টারমার তাঁর বিভাগের খরচ কমাতে বাধ্য হন। ২০০৯ সালের কেলেঙ্কারির জেরে এমপিদের পার্লামেন্টারি ব্যয় নিয়ে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করাসহ নানা গুরুত্ব সিদ্ধান্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে।

আইনি কার্যক্রমে ভূমিকার পুরস্কার হিসেবে ২০১৪ সালে নাইটহুড উপাধি পান কিয়ার স্টারমার। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব কতটা সফল? তাঁর মেয়াদের শেষের দিকে বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে স্টারমার স্বীকার করেছিলেন, অসহায় ভুক্তভোগীরা এখনো বিচারব্যবস্থার অবজ্ঞার শিকার হয়ে থাকেন।

পেশাজীবনে পরিবর্তন

কিয়ার স্টারমারের বয়স ৫২ বছর হওয়ার পর তাঁর পেশাগত জীবনে পরিবর্তন আসে। তিনি উত্তর লন্ডনে লেবার পার্টির একটি নিরাপদ আসনে মনোনয়ন পান। সেখানে সহজে জয় পান। তিনি ও সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির ঋষি সুনাক একই দিনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু সময়টা লেবার পার্টির জন্য সুখকর ছিল না। কারণ, তখন কনজারভেটিভরা মাত্রই নির্বাচনে জিতেছিল এবং জেরেমি করবিন লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর দলের ভেতরে দ্বন্দ্বের উপক্রম শুরু হয়।
একজন ‘ব্যাকবেঞ্চার’ থেকে লেবার পার্টির নেতৃত্বে এবং এখন ডাউনিং স্ট্রিটে কিয়ার স্টারমারের যাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু বলা ও লেখা হয়েছে। তবে কিছু বিষয় রয়েছে উল্লেখ করার মতো।

জেরেমি করবিন লেবার পার্টির নেতা হওয়ার পর কিয়ার স্টারমারকে ছায়া অভিবাসন মন্ত্রী বানান। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্রেক্সিট গণভোটের পর করবিনকে লেবার পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরাতে দলের সামনের সারির একদল নেতা পদত্যাগ করেন। সেই দলে স্টারমারও ছিলেন। এ সময় তাঁর ছায়া মন্ত্রী হিসেবে এক বছরও হয়নি। কিন্তু তাঁদের ওই চেষ্টা তখন সফল হয়নি। করবিন তখন তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া নেতাদের সঙ্গে আপসরফা করেন এবং কিয়ার স্টারমার ছায়া ব্রেক্সিট মন্ত্রী পদে ফেরেন।

এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলে কিয়ার স্টারমারের দায়িত্ব বদলেছে। ২০১৯ সালে বিবিসির ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জেরেমি করবিন দুর্দান্ত একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি এ সময় করবিনকে শতভাগ সমর্থন দিয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করার ও সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কথা বলেন। অন্যরা যখন করবিনের সঙ্গে কাজ করতে অনীহা জানান, তখন তিনি করবিনের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচন লেবার পার্টির জন্য বিপর্যয়কর হয়। এরপর করবিন দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে তাঁর জায়গায় আসেন স্টারমার।

কিয়ার স্টারমার যখন লেবার পার্টির নেতা হন, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন কনজারভেটিভ নেতা বরিস জনসন আরও বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় থাকবেন। অনেকে স্টারমারকে লেবার পার্টিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারেন, এমন নেতা হিসেবে দেখেছিলেন। তখন গুটিকয়েক মানুষই মনে করেছিলেন যে তিনি আবার লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় নিতে পারেন।

কিন্তু সেই পরিবর্তন কবে আসবে? জনমত জরিপগুলোয় এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ২০২০ ও ২০২১ সালের জনমত জরিপে জনসনের কনজারভেটিভদের পেছনে ছিল লেবার পার্টি। ওই সময় হার্টলপুল উপনির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ের পর করোনা মহামারিতে বরিস জনসনের ডাউনিং স্ট্রিটে অনুষ্ঠান আয়োজনের কেলেঙ্কারির খবর বাইরে আসতেই সব বদলে যায়।

ওই সময় জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে কনজারভেটিভদের চেয়ে স্পষ্ট এগিয়ে লেবার। এরপর লিজ ট্রাসের বাজেট ঘোষণার পর থেকে ক্রমেই লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

একজন নির্দয় নেতা

কিয়ার স্টারমারের মিত্ররা যুক্তি দেন, লেবার পার্টিতে বড় পরিবর্তন না আনলে আজকের এ পরিবর্তন ঘটত না। কিয়ার স্টারমার দলের বিষয়ে কখনো কখনো নির্দয় আচরণ করেছেন। জেরেমি করবিনকে তিনি লেবার পার্টির পার্লামেন্টারি দল থেকে বাদ দিয়েছেন। এমনকি তাঁকে লেবার পার্টি থেকে নির্বাচনে মনোনয়নও দেননি। তাঁর সময়ে দলের অর্থনৈতিক নীতি সংহত করা হয়েছে, অর্থাৎ মানানসই না হলে সেই নীতি বাতিল করা হয়েছে। তিনি ব্রিটিশ দেশপ্রেমকে আঁকড়ে ধরেছেন।

কিয়ার স্টারমারের বয়স এখন ৬১ বছর। তিনি ২০০৭ সালে ভিক্টোরিয়াকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d