Bangladesh

খেলাপি ঋণের দুর্নাম ঘোচাতে অবলোপন বৃদ্ধি ১৮ গুণ, অনিয়মের ঝুড়ি ছোট করার চেষ্টা

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির কারণে ঋণ আদায় ক্রমাগত কমছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপির মধ্যে থেকেও আদায় বা নবায়ন করার প্রবণতা কম। ফলে কোনো ঋণ টানা দুই বছর খেলাপি থাকার পর সেগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের দ্বিগুণ অর্থ আটকে থাকছে, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের স্থিতিপত্র বড় হয়ে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। ফলে দেশে বিদেশে ব্যাংক খাতের ঝুঁকির মাত্রাটি বড় আকারে ওঠে আসছে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ ব্যাংকগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নাম ঘোচাতে ও ঝুঁকি কমাতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে অবলোপন বা রাইটঅফ করে মূল হিসাব থেকে আলাদা একটি হিসাবে রাখছে। ফলে প্রলেপের কারণে কমে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলো গত ২০ বছরে ৬৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। অবলোপন বেড়েছে ১৮ গুণের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় তা কমাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এতে সুফল মিলছিল না। ১৯৯৮ সালে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের মধ্যে ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশই ছিল খেলাপি ঋণ। এ হার কমাতে বিশেষ ছাড়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয় ও ঋণ বিতরণ বাড়ানো হয়। এর মাধ্যমে ২০০৩ সালে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে ২২ দশমিক ১০ শতাংশে নামানো সম্ভব হয়। এর বেশি আর কমানো সম্ভব হচ্ছিল না। তখন মোট খেলাপি ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ অবলোপন (ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে বাদ দিয়ে আলাদা একটি হিসাবে রাখা) করে খেলাপি ঋণ কমাতে ২০০৩ সালে একটি নীতিমালা করে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী শতভাগ প্রভিশন রেখে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যাবে। এই সুযোগ নিয়ে যেসব ব্যাংকের প্রভিশন বেশি ছিল তারা খেলাপি ঋণ অবলোপন শুরু করে। প্রথম বছরেই অর্থাৎ ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা থেকে ঋণ রাইটঅফ করে।

এরপর থেকে অবলোপনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত আট বছর ধরে অবলোপনের পরিমাণ বেশি মাত্রায় বাড়ছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে অবলোপনের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে তা আরও বেড়ে ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ অবলোপনের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করা হয়। তখন এর আলোকেও অবলোপনের গতি কিছুটা কমে যায়। কারণ এতে বলা হয়, কোনো ঋণ মন্দ হিসাবে টানা তিন বছর খেলাপি হিসাবে থাকলে তা অবলোপন করা যাবে। আগে দুই বছর মন্দা হিসাবে থাকলেই তা অবলোপন করা যেত। অবলোপনের আগে খেলাপির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে মন্দার কারণে প্রভিশন রাখার প্রবণতাও কমে যায়। ফলে অবলোপনও কমে যায়। ২০১৯ সালে অবলোপনের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায়। ২০২০ সালে তা সামান্য বেড়ে ৫৬ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা হয়। ২০২১ সালে অবলোপন বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে ৬০ হাজার ৪০০ কোটি ও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত তা আরও বেড়ে ৬৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০০৩ সাল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন বেড়েছে ১৮ গুণের বেশি।

অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে চাপ দিতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ ঋণ অবলোপন করা হলেও সেগুলো খেলাপি হিসাবেই চিহ্নিত হয়। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে অবলোপন কমাতে ওইসব ঋণ নিয়মিত করা বা আদায়ের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসাবে পূবালী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগ করে অবলোপন করা ঋণ আদায়ের পদক্ষেপ নেয়। এর মাধ্যমে কিছু ঋণ আদায়ও হয়েছে। ফলে গত বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের নিট স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় বা নবায়ন করা হয়েছে ১৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। যা মোট অবলোপনের ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

গত ২০ বছরে সরকারি ব্যাংকগুলো রাইটঅফ করেছে ২৫ হাজার ২২০ কোটি টাকা, এখন স্থিতি ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। নবায়ন বা আদায় করেছে কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৬১০ কোটি টাকা রাইটঅফ করেছে। এখন স্থিতি ৩৫০ কোটি টাকা। আদায় বা নবায়ন করেছে কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৪০ হাজার ৬০ কোটি টাকা রাইটঅফ করেছে। এখন স্থিতি ৩১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলো রাইটঅফ করেছে ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, এখন স্থিতি ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা। আদায় বা নবায়ন করেছে কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ অবলোপন বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত মাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশে এর অপব্যবহার হচ্ছে। জাল-জালিয়াতি বা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। এটি মোটেই ঠিক নয়। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এ খাতে অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কমানো হলে তার কোনো সুফল মিলবে না। যেমন এখন অবলোপনের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ ছিল ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৫ গুণ। ঋণ প্রবাহ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণও। তবে ঋণ বেশি বাড়ায় ও খেলাপি ঋণ তুলনামূলক কম বাড়ায় খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে কম। অর্থাৎ আগের চেয়ে কমেছে। ১৯৯৮ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা আরও কমে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০০৩ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণের হার কমেছে ১২ শতাংশ।

নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০০৩ সালে প্রভিশন ছিল ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে তা বেড়ে প্রভিশন সংরক্ষণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকায়। একই সময়ে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায়। ওই সময়ে প্রভিশন সংরক্ষণ বেড়েছে ২১ দশমিক ৩৩ গুণ, ঘাটতি বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৯ গুণ। একই সময়ে মোট খেলাপি ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে ডিসেম্বরে তা কিছুটা কমে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor