গণপূর্ত ও তদন্ত কমিটি দুই মেরুতে, নানা প্রশ্ন

সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় মিলেছিল সাদা পাউডার। সরকারের প্রশাসনিক সদরদপ্তরের মতো স্পর্শকাতর ভবনের করিডোরে কীভাবে সাদা পাউডার এলো! কলাসপিবল গেটে তালা থাকার পরও কীভাবে ষষ্ঠ তলায় আগুনে পুড়ে কুকুর অঙ্গার হলো– এসব রহস্যের উত্তর নেই সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
এদিকে সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৪) ভাষ্য, যে স্থানে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কথা বলা হয়েছে, সেখানে ছিল টেলিফোনের তার। এই তার থেকে বৈদ্যুতিক স্পার্ক হওয়ার সুযোগ একদম নেই। তবে তদন্ত কমিটি বলছে, বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। আগুন লাগার সূত্র নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও তদন্ত কমিটি এখনও দুই মেরুতে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভেদ।
এ ছাড়া ২৫ ডিসেম্বর ছিল বড়দিনের ছুটি। সেদিন সচিবালয় ছিল বন্ধ। তবু অস্থায়ী পাস নিয়ে বেশ কয়েকজন অপরিচিত মানুষ সচিবালয়ে ঢুকেছিলেন। এসব তথ্যও প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। সব মিলিয়ে আগুনের ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে কমিটি গভীর তদন্তে যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাড়াহুড়ো করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় কেপিআইভুক্ত হওয়ার পরও সেখানকার নিরাপত্তার দুর্বলতার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। তবে এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে। কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, সেটিও উল্লেখ করা হয়নি।
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কী দুর্বলতা ছিল, এসবের কিছুই বলেনি তদন্ত কমিটি। গণপূর্ত বিভাগের গত নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সেই মাসে সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য অভিযোগ জমা পড়েছিল ১৫০টি। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগ যথাসময়ে নিষ্পত্তি হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভবনটিতে ছিল অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক ঘাটতি। ছিল না ফায়ার প্রটেকশন ও ডিটেকশন সিস্টেম। ফলে প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও শনাক্ত করা যায়নি। ফ্লোরে হোসপাইপ সিস্টেম থাকলেও তা ছিল অকার্যকর, নজেলবিহীন। এ জন্য সহজে সরবরাহ করা যায়নি পানি। জানা যায়, হোসপাইপে নজেল (তামার বা কপার) ছিল। তবে এগুলো আগেই চুরি হয়ে গেছে। আবার কলাপসিবল গেটের ভেতরে-বাইরে ছিল তালা। এতে আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ মাহমুদ উল্লা সমকালকে বলেন, যেখানে স্পার্ক হয়েছে, সেই তার দিয়ে কী ব্যবহার হতো– তদন্ত কমিটি সেটি পরিষ্কার করে বলতে পারত। তদন্ত কমিটি আরও গভীরে গেলে ভালো হতো। নিশ্চয়ই ওই তারের কোথাও সংযোগ ছিল। ছুটির দিন গভীর রাতে তারটি কেন সচল ছিল? এটি একটি বড় ইস্যু, তাই বিস্তারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা উচিত ছিল। তিনি বলেন, বিদ্যুতের তারে লোড কম হলে স্পার্ক হওয়ার শঙ্কা কম। টেলিফোনের লাইন থেকে তো স্পার্ক হওয়ার সুযোগেই নেই।
এসব বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনির মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।
৭০৪, উপদেষ্টা নাহিদের কক্ষ নয়
তদন্ত কমিটির এক সদস্যের ধারণা, ৭০৪ নম্বর কক্ষটি টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের। ৫২৪ নম্বর কক্ষটি একজন অতিরিক্ত সচিবের। কক্ষ দুটির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে রেফ্রিজারেন্ট নির্গত হয়ে প্রজ্বালনের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। তবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, নাহিদ ইসলাম বসেন ৭০২ নম্বর কক্ষে। তাঁর একান্ত সচিবের কক্ষ ৭০১। ৭০৩ নম্বর কক্ষটি মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী সমকালকে বলেন, আগুনের সূত্রপাতের স্থানে টেলিফোন বক্স আছে। এর সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারের সংযোগও ছিল। এ কারণে দেয়াল ভেঙে যাচাই করে দেখা হয়েছে। সবকিছু নিশ্চিত হয়ে আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি। তিনি দাবি করেন, বিদ্যুতের লোড কম থাকলেও স্পার্ক হতে পারে।
তিনি বলেন, যারা সচিবালয়ের বৈদ্যুতিক কাজের মেরামত ও নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত, তারা অবশ্যই এ ঘটনার জন্য দায়ী। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা। এ জন্য টাকা বরাদ্দ ছিল, কিন্তু কাজ করা হয়নি। তবে প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিষয়গুলো আসেনি। সচিবালয়ের আগুন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। এ কারণে দ্রুত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। আগামী শুক্রবারের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বৈদ্যুতিক মেরামতের টাকায় কর্মীর বেতন
গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি তিন লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ছয় কোটি আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতন বাবদ খরচ হয়েছে। এই অর্থবছরে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে সাড়ে ১২ কোটি। এর মধ্যে আউটসোর্সিং কর্মীর জন্য প্রায় সাত কোটি টাকার দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। জানা যায়, মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দের টাকা আউটসোর্সিং কর্মীর বেতনের নামে লুটপাট হয়েছে। কারণ, সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য ১৯৬ জনকে নিয়োগ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এর পর আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। অথচ গণপূর্ত অধিদপ্তর অর্থ বিভাগের অনুমতি ছাড়া আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ দিয়ে মেরামতের টাকা বেতন হিসেবে দেখিয়েছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান সমকালকে বলেন, মেরামত খাতের টাকায় আউটসোর্সিং কর্মীর বেতন দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দুটোর কোড আলাদা। তবে বিষয়টি পুরোপুরি আমি জানি না। তিনি বলেন, যেসব মন্ত্রণালয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তারা তালিকা দিলে আমরা কাজ করব। বাজেটের বিষয়টি আমরা টাইম টু টাইম নজরে রাখছি। সচিবালয়ের ভবনগুলো অগ্নিপ্রতিরোধে আধুনিকায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, আগুনের সূত্রপাতের স্থান তদন্ত কমিটির সদস্যরা তিন দিন যাচাই করেছেন। কিন্তু ভিজিবল কোনো কিছু চোখে পড়েনি। ইন্টেরিয়র কাজের জন্য দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, তারা ওই স্থানে বিদ্যুতের কোনো তার দেখেননি।
প্রায় সব ভবনেই অগ্নিদুর্ঘটনার শঙ্কা
গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৭ নম্বর ভবনটি আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ জন্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রস্তাব করা হলেও কাজ হয়নি। অর্থ বিভাগ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের টাকা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে বলেছে। অথচ মেরামত খাতে বরাদ্দ অনেক কম। এ ছাড়া গণপূর্ত বিভাগ ৭ নম্বর ভবনটির বৈদ্যুতিক সংযোগ উন্নতির জন্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছে। সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সচিবালয়ের প্রায় সব ভবনে বিদ্যুতের তারের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে।
গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়াজ মো. তানভীর আলম সমকালকে বলেন, তদন্ত কমিটি লুজ কানেকশনের বিষয়টি বলে ফেলেছে। এটি এখনও নিশ্চিত হয়নি। কারণ, আগুনের সূত্রপাতে বৈদ্যুতিক তার ছিল না। তার ছিল কক্ষের ভেতর। ওইখানে একটি বিদ্যুতের সংযোগ বক্স ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আগুনের নমুনা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, কী হয়েছে। তবে করিডোরেই লুজ কানেকশনটা পাওয়া গেছে। কোন কক্ষ থেকে হয়েছে, সেটি এখনও জানা যায়নি। সূত্রপাতের স্থানে ছিল টিঅ্যান্ডটির (টেলিফোন) বক্স। টেলিফোন থেকে বিদ্যুৎ স্পার্ক হওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া রাতে বিদ্যুতের কোনো লোডও ছিল না।
অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সমকালকে বলেন, অর্থের অভাবে কাজ করতে পারেনি; বিষয়টি আমি জানি না। আবার মেরামতের জন্য বরাদ্দের টাকায় আউটসোর্সিং কর্মীর বেতন দেওয়া হয়েছে– এটাও জানি না।
আমলাদের নিয়ন্ত্রণে কলাপসিবল গেট ও গুরুত্বপূর্ণ কক্ষের চাবি
সচিবালয়ের কক্ষের তালা বন্ধ করেন ফরাসরা। তারা এ পদেই চাকরি করেন। তবে সচিবালয়ের কলাপসিবল গেট ও গুরুত্বপূর্ণ কক্ষের চাবি থাকে আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। এতে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা নয়; বরং সচিবালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর খোলা থাকে রাত পর্যন্ত। জানা যায়, আগুন লাগা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কলাপসিবল গেটের চাবি ছিল কম্পিউটার অপারেটরদের হাতে।
ফায়ার সার্ভিসের সচিবালয় স্টেশনের সহকারী স্টেশন অফিসার আনোয়ার পারভেজ সমকালকে বলেন, কলাপসিবল গেটের ভেতরে-বাইরে তালা থাকায় আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগেছে। প্রতিটি কক্ষ ছিল ইন্টেরিয়র মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা। ইন্টেরিয়রের কাজের কারণে আগুনের তাপ ছিল অনেক বেশি। তবে তালা সহজে খোলা গেলে আগুন দ্রুত নেভানো যেত।
উপদেষ্টা ও তদন্ত কমিটির মধ্যে মতানৈক্য
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সচিবালয়ে অগ্নিদুর্ঘটনার পরদিন বলেন, আগুনে পাঁচ মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা ডিজিটাল দেশের কথা শুনেছি। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর বোঝা গেল, কার্যত ডিজিটাল হয়নি। তবে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, আমি সশরীরে দুবার বিল্ডিংয়ে উঠেছি। প্রতিটি কক্ষ ঘুরে দেখেছি। কয়েকটি কক্ষ পুড়েছে; সেখানে নথি পোড়েনি।
ইন্টেরিয়র করতে লাগবে অগ্নিপ্রতিরোধক উপাদান
তদন্ত কমিটি সচিবালয়ের অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবছর মেইনটেন্যান্স অডিট করতে হবে। অগ্নিপ্রতিরোধক উপাদান ছাড়া ইন্টেরিয়রের কাজ করা যাবে না। ফায়ার প্রটেকশন ও ডিটেকশন পদ্ধতি সব ভবনে রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি স্বাভাবিকভাবে ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে। সংযোগ করিডোরগুলো ভেঙে উঁচু করতে বলা হয়েছে।
যা ঘটেছিল
গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে আট সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিটি গত ৩১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়।