International

গণহত্যার ‘অভিপ্রায় স্পষ্ট’: আজ আইসিজে-তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ দাখিল করবে দক্ষিণ আফ্রিকা

কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ক্যাথলিন পাওয়েল বলেন, ‘ইসরায়েল রাষ্ট্রের গণহত্যার অভিপ্রায় প্রমাণ করা এবং দেশটির কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে দেখানো দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

গত সপ্তাহ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনি বিশেষজ্ঞরা অজ্ঞাত স্থানে বসে গাজায় ইসরায়েলের জেনোসাইডের অভিপ্রায়ের শতশত পৃষ্ঠা প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। অন্যদিকে, গাজাসীমান্তে জড়ো হওয়া ইসরায়েলি নেতারা গাজাকে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে মুক্ত করার জন্য অবরোধ ও বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন।

সোমবার বেয়েরির সামরিক সুরক্ষিত একটি এলাকায় অনুষ্ঠিত ‘গাজায় বসতি স্থাপনের প্রস্তুতি’ শীর্ষক সম্মেলনে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির গাজার বর্তমান বাসিন্দাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা বলে ইঙ্গিত দেন, ভবিষ্যতে সেখানে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করা হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বলে বিবেচিত।

“আমরা তাদের বলব, ‘আপনাদের চলে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছি,'” বলেন বেন-গাভির। ‘ইসরায়েলের ভূমি আমাদেরই,’ মন্তব্য করেন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার কূটনীতিকেরা মনে করেন, এ ধরনের বক্তব্য ইসরায়েলের গণহত্যামূলক অভিপ্রায়ের প্রমাণ, যা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) চলমান মামলায় তুলে ধরা হবে।

আইনজীবী ও কূটনীতিকেরা আল জাজিরাকে জানান, সোমবারের (২৮ অক্টোবর) মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি বিস্তারিত অভিযোগপত্র আইসিজেতে জমা দিতে হবে। এ অভিযোগপত্রের মাধ্যমে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক কার্যক্রমকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করতে চায় দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইসরায়েলের গণহত্যার বিষয়ে নিয়মিত নতুন নতুন তথ্যপ্রমাণ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের আইনি দলকে নির্দেশনা দিয়েছেন, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই তাদের হাতে থাকা তথ্য-প্রমাণ আদালতর জমা দিতে।

আইনি দল আশাবাদী যে, তাদের সংগৃহীত শতাধিক পৃষ্ঠার প্রমাণ মামলাটি টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট হবে।

হেগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত ভুসি ম্যাডোনসেলা আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হলো প্রমাণ এত বেশি যে, আমরা সেগুলো সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

দক্ষিণ আফ্রিকার ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড কোঅপারেশন-এর মহাপরিচালক জেন ড্যাঙ্গর জানান, ‘আইনি দল সবসময় আরও সময় চায়, আরও প্রমাণ আসছে বলে জানায়। তবে এখন তাদের [ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যান] প্রমাণ সংগ্রহ থামিয়ে যা যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা দিয়ে কাজ চালাতে হবে।’

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এ অভিযোগপত্রে গাজায় ব্যাপক হতাহতের একটি প্যাটার্ন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের আক্রমণে নিহত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা মনে করে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিপরীতে এটি ইসরায়েলের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া।

গত ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন আবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা এটির দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে আসছে — ইসরায়েলের লক্ষ্য কেবল সামরিক প্রতিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং চরম সহিংসতা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মাধ্যমে গাজার জনগণকে নির্মূল করাই তাদের উদ্দেশ্য।

এর আগে আবেদনের প্রথম দফায় দক্ষিণ আফ্রিকা ৮৪ পৃষ্ঠার নথিতে ইসরায়েলকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করে এবং গাজায় আগ্রাসন বন্ধে আইসিজের হস্তক্ষেপ চায়।

হেগে মৌখিক যুক্তিতর্কের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা ইসরায়েলি রাজনীতিকদের সে সময় দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য, ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও ক্লিপ ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি জমির চিত্র তুলে ধরেন।

‘প্রমাণের চ্যালেঞ্জ?’

আইসিজে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রমাণ উপস্থাপনের সময়সীমা সোমবার পর্যন্ত দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গণহত্যার অভিপ্রায় প্রায় ‘অপ্রমাণযোগ্য’ হতে পারে।

কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ক্যাথলিন পাওয়েল বলেন, ‘ইসরায়েল রাষ্ট্রের গণহত্যার অভিপ্রায় প্রমাণ করা এবং দেশটির কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে দেখানো দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

তিনি বলেন, ‘যদি তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের গণহত্যামূলক বক্তব্য খুঁজে পায় এবং দেখাতে পারে যে সেগুলো ধ্বংসযজ্ঞের নির্দিষ্ট পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত, তাহলে এটি একটি শক্তিশালী মামলা হতে পারে। তবে প্রমাণ করা খুব কঠিন।’

পাওয়েল আরও বলেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গণহত্যা কনভেনশনের আওতায় অভিযোগ তোলার মানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রমাণ করতে হবে যে, এর জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র দায়ী।

‘রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের অভিপ্রায়কে রাষ্ট্রের অভিপ্রায় হিসেবে প্রমাণ করা কঠিন,’ ব্যাখ্যা করেন পাওয়েল। ‘গণহত্যার অভিপ্রায় প্রমাণ করতে হলে আপনাকে [ইসরায়েলি] রাষ্ট্রের দিক থেকে ভিন্ন ধরনের প্রমাণ দিতে হবে।’

আইনের অভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি দক্ষিণ আফ্রিকা ডলাস স্পেশালিস (নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য) প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ মামলাটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জেন ড্যাঙ্গর অবশ্য বলছেন, তাদের মামলা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছে।

‘এটি গণহত্যার একটি টেক্সটবুক উদাহরণ। [গণহত্যার] অভিপ্রায় এখানে সুস্পষ্ট,’ ড্যাঙ্গর বলেন।

‘গণহত্যার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য না থাকলে এ ধরনের অপরাধ কেবল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এখানে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ স্পষ্ট,’ বলেন তিনি।

“সবাই ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্য দেখছে, এমনকি সাধারণ ইসরায়েলিরাও বলছে ‘সব গাজাবাসীকে, এমনকি শিশুদেরও হত্যা করো,'” যোগ করেন তিনি।

‘দম ফেলার ফুরসত নেই’

কঠোর সময়সীমার মধ্যে কাজ চালিয়ে নিতে দক্ষিণ আফ্রিকা আইনি বিশেষজ্ঞদের একটি দক্ষ দল গঠন করেছে। যার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজন শীর্ষস্থানীয় সিনিয়র আইনজীবী, একজন আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক, একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার এবং বেশ কয়েকজন জুনিয়র কাউন্সেল ও গবেষক রয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০০ জন সদস্য গত নয় মাস ধরে মামলার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন।

রাষ্ট্রদূত ম্যাডোনসেলা বলেন, ‘আমরা অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে কাজ করছি।’

জেন ড্যাঙ্গর বলেন, এ আইনি গবেষক ও আইনজীবীদের কয়েক হাজার পৃষ্ঠার ‘অচিন্তনীয় বর্বরতার’ প্রমাণকে সংক্ষিপ্ত করে আইনি যুক্তিতে রূপ দিতে হয়েছে।

আইনি গবেষকদের জানানো হয়েছিল, কেবল গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের উদাহরণগুলো উল্লেখ নয়, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার যুক্তিতে ‘ইসরায়েলের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য’ হিসেবে গাজার জনগণকে নির্মূল করা এবং ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি প্রমাণ করাই প্রধান লক্ষ্য।

জমা দেওয়া শতাধিক পৃষ্ঠার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেছে যেখানে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ‘গাজাকে নিশ্চিহ্ন করা’ এবং ‘ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বিতাড়নের’ কথা বলেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের এসব বক্তব্যকে গণহত্যার উদ্দেশ্যের পরিষ্কার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করছে।

মামলাটি দাখিলের পর ইসরায়েল ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত তাদের পালটা যুক্তি উপস্থাপন করতে পারবে। এর পর ২০২৬ সালে আইসিজেতে মৌখিক শুনানি হবে; ফলে পুরো প্রক্রিয়া কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।

মামলাটি গ্রহণ করা হলে এটি একটি ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করবে। কারণ ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে এখনো পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে সফল বিচার করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলার সম্ভাব্য রায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বাইরেও প্রভাব ফেলতে এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত সহিংসতা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আইনের একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d