Hot

গণ-অভ্যুত্থান: ৯০-এ অংশগ্রহণ, ২৪-এ প্রত্যক্ষণ

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে আমরা আন্দোলনের মুখে বেগম খালেদা জিয়াকে ক্ষমতা ছাড়তে দেখি। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র তাতে ছিল না। একইভাবে ২০০৭ সালে আন্দোলনের মুখে আমরা সরকার পরিবর্তন হতে দেখেছি। সেটাও গণ-অভুত্থান ছিল না। যে সরকারকে সরে যেতে হয়েছিল, সেটাও রাজনৈতিক সরকার ছিল না। এ জন্য আমরা আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের সংখ্যা দেড় বলছি।

বাংলাদেশের সমান বয়সী এই আমরা ৫৩ বছরে দুই দুটি ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান দেখলাম। আন্দোলনের মুখে সরকার পতন দেখেছি দেড়বার। আর একবার রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান। একবার রক্তপাতহীন। রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে  আরও একটি রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। সেটা অবশ্য সফল হয়নি। এর বাইরে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের পর সিপাহি বিদ্রোহে পাল্টা অভ্যুত্থানে রক্তপাত দেখেছি অনেক।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে প্রথম রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করে বাংলাদেশ। একই বছরের ২ ও ৭ নভেম্বর ঘটে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান। প্রথমটিতে রক্ত না ঝরলেও দ্বিতীয়টিতে অনেক সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। ক্ষমতাসীন হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

পরের কয়েক বছর জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক ক্যু চেষ্টা হলেও কোনোটিই সফল হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হন। চট্টগ্রামে ঘটা ওই ঘটনায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটেনি। তবে এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে নেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে আমরা আন্দোলনের মুখে বেগম খালেদা জিয়াকে ক্ষমতা ছাড়তে দেখি। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র তাতে ছিল না। একইভাবে ২০০৭ সালে আন্দোলনের মুখে আমরা সরকার পরিবর্তন হতে দেখেছি। সেটাও গণ-অভুত্থান ছিল না। যে সরকারকে সরে যেতে হয়েছিল, সেটাও রাজনৈতিক সরকার ছিল না। এ জন্য আমরা আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের সংখ্যা দেড় বলছি।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গণজাগরণ দেখেছে। সেটা ছিল এক অর্থে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। ওই সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম জাগরণ দেখেছে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। এরপর কোটা সংস্কারের আন্দোলনেও ছাত্রদের জাগরণ ছিল। তবে ওই কোটাকে কেন্দ্র করেই এবার সংঘটিত হলো ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান।

১৯৯০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ নূর হোসেনের একটি ম্যুরাল।

প্রজন্ম অনুযায়ী বিশ্লেষণী চোখে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯০ সালে ২২-৩ বছর বয়সী যে শিক্ষার্থীরা জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিল, এবার সেটা ঘটিয়েছে তাদের সন্তানেরা। এরশাদের বিরুদ্ধে ওই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের একজন কর্মী হিসেবে এবার যখন গণ-অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করছিলাম, তখন আমাদের চোখে সেই স্মৃতি ভেসে উঠছিল। এবার যেমন রংপুরের আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড ছাত্র আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গেছে, ঢাকায় মুগ্ধর আত্মাহুতি তা ছড়িয়ে দিয়েছে; ১৯৯০ সালে আমাদের সময় সেই বাঁক বদলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জের জেহাদ এবং ঢাকায় নিহত ডা. মিলনের নাম।

যেভাবে ৯০ গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা

সেদিন ছিল ১০ অক্টোবর। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে তিন জোট যুগপৎ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ডেকেছিল। তিন জোটের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট। শরিকদের মধ্যে এ ছাড়াও ছিল বাকশাল এবং কমিউনিস্ট পার্টি। সাত দলীয় জোটে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো শুধুই সাইনবোর্ড-সর্বস্ব। আর পাঁচদলীয় জোটে বামপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ-বাসদ। এ ছাড়া কয়েকটি ছোট ছোট বাম জোট ছিল আন্দোলনে। জামায়াতও ওই আন্দোলনে ছিল।

তবে কোনো জোট তাদের নেয়নি।

আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি থাকলেও দুপুরের পর আমাদের ক্লাস চলছিল। ক্লাস নিচ্ছেলেন ড. সিতারা পারভীন। হঠাৎ বাইরে গুলির মতো আওয়াজ। ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে বোঝা গেল গুলি নয়, টিয়ারগ্যাস। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছে। একজন নিহত হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেল। সিতারা আপা বললেন, ‘একজন স্টুডেন্ট নিহত হয়েছে, আর তোমরা এখনো ক্লাসরুমে!’

তাঁর কথা যেন মুহূর্তেই আগুনে ঘি ঢেলে দিল। আমরাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লাম। একপর্যায়ে পুলিশ পিছিয়ে গেলে জানা গেল মতিঝিলে যে ছাত্রটি নিহত হয়েছেন, তাঁর নাম জাহিদ। ছাত্রনেতারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ এনে বঙ্গবন্ধু হলে রেখেছে। আমার মনে হলো, জাহিদ মানে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র জাসদ ছাত্রলীগের জাহিদ ভাই (জাহিদ রহমান)। নিশ্চিত হতে বঙ্গবন্ধু হলে গেলাম। সেখানে লাশের সামনেই জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনিও সেখানে এসেছিলেন জাহিদ নাম শুনে, আমি নিহত হয়েছি আশঙ্কা করে।

শহীদ নূর হোসেন। ছবি: পাভেল রহমান

পরে নিশ্চিত হওয়া গেল নিহত ছাত্রটির নাম আসলে জেহাদ। ছাত্রদলের কর্মী তিনি। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া বাড়ি। সাতদলীয় জোটের কর্মসূচিতে যোগ দিতে তাঁর ঢাকায় আসা।

সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়া ক্যাম্পাসে আসলেন। শেখ হাসিনাও এরপর। জেহাদের লাশ ততক্ষণে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুই নেত্রীই ছাত্রনেতাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে বললেন। ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন এবং ডাকসুর সমন্বয়ে তাৎক্ষণিক গঠিত হলো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঢাকার বাতাসে একটু একটু হিম ভাব। সূর্যাস্তের একটু পর নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্নে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের বাইরেও হাজারো সাধারণ ছাত্র একসঙ্গে শপথ পাঠ করলেন এরশাদের পতনের আগে কেউ ঘরে ফিরে যাবে না। শেখ হাসিনা ওই শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। শেষে তিনি ‘জয় বাংলা’ বললে চারদিক থেকে প্রতিবাদ আসে। তখন মনে হচ্ছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই না তা ভেস্তে যায়।

তবে ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব ও সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। শীর্ষ ছাত্রদল নেতা ও ডাকসু ভিপি আমানউল্লাহ আমান ও জিএস খায়রুল কবির খোকন, ছাত্র ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও নাসির-উদ-দৌজা, জাসদ ছাত্রলীগের নাজমুল হক প্রধান ও শফী আহমেদ, বাকশাল ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ও এস এম কামাল হোসেন, ছাত্র ফ্রন্টের মোস্তফা ফারুক ও বেলাল চৌধুরী এবং ছাত্র মৈত্রীর জহিরউদ্দিন স্বপন ও নূর আহমেদ বকুলসহ ছাত্র নেতৃত্ব সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

নব্বইয়ের ১০ অক্টোবর ওই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের মাধ্যমেই এরশাদের পতনযাত্রা শুরু হয়। এ জন্য সময় লাগে দুই মাসেরও কম।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা

তখন বাংলাদেশে যে মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, তার সবগুলোসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জেহাদের মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মনিরসহ আরও কয়েকজন নিহত হন। জেহাদের পর মনির– আন্দোলনের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। একপর্যায়ে এরশাদের ইশারায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার্থীরা যার যার বাড়ি ফিরে গেলে ঢাকার আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। ছাত্রনেতারা তাই ভিন্ন পথ ধরেন। সারা দেশে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে একের পর এক সমাবেশ করতে থাকেন। সমাবেশগুলোতে মানুষের জমায়েত হয় দেশের দুই নেত্রীর জনসভাগুলোর মতো।

৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্রদের একটি মিছিল

মাসখানেকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হয়। সঠিক তারিখটা মনে করতে পারছি না। সম্ভাবনা বেশি যে সেটা ১০ নভেম্বরের পরে হবে। কারণ, ১০ নভেম্বর হচ্ছে শহীদ নূর হোসেন দিবস। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক লিখে রাজপথে নেমে নিহত হয়েছিলেন নূর হোসেন। নিশ্চয়ই এরশাদ চাননি যে ওই দিবসকে কেন্দ্র করে ঢাকায় তীব্র আন্দোলন হোক। তাই সম্ভবত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হয়।

মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও

বিশ্ববিদ্যালয় খুলল। কিন্তু ক্লাসের কোনো বালাই নেই। সকাল-সন্ধ্যা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিল-সমাবেশ। কোনো দলে না থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাতে অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ। এর মধ্যেই ঘোষণা করা হলো ১৭ নভেম্বর মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচি।

মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও?

এ রকম কর্মসূচির নাম আগে শুনিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত শফী আহমেদ এ কর্মসূচি প্রস্তাব করেছেন। ডিরেক্ট অ্যাকশনধর্মী এ রকম কর্মসূচির কথা জেনে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেন নাচন উঠল। মনে করা হচ্ছিল, এর সাফল্যের মধ্যেই এরশাদ পতনের পথ আরও খুলে যাবে। হয়েছিলও তা-ই।

ওই দিন সকালে মধুর ক্যানটিন থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর যে মিছিল বের হয়, তার তোড়ে শাহবাগে পুলিশের ব্যারিকেড মুহূর্তেই নাই হয়ে যায়। মিছিলটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় দিয়ে মন্ত্রীপাড়ায় ঢুকে যাওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। তবে এখনকার মতো তখনো দলীয় মাস্তানদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রীপাড়াকে কেন্দ্র করে সবগুলো মোড়েই জাতীয় পার্টি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো সমাবেশের নামে সশস্ত্র বাধা গড়ে তুলেছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে ছিল জামালউদ্দিনের নেতৃত্বে ব্যাংক কর্মচারীদের সশস্ত্র অবস্থান। মিছিলটি সেখানে পৌঁছামাত্রই মুহুর্মুহু গুলি শুরু হয়ে যায়। গুলির মুখে টিকতে না পেরে মিছিলের একটি অংশ শাহবাগ দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। সামনের অংশটি সাকুরার গলি দিয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

তবে সেটা ছিল অল্প সময়ের জন্য। শিক্ষার্থীরা আবার সমবেত হয়ে হাইকোর্ট মোড় দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় পার্টির অস্ত্রধারীরা গুলি করে। পরদিন পত্রিকায় তাদের কয়েকজনের অস্ত্র হাতে ছবিও ছাপা হয়। মন্ত্রীপাড়াকে কেন্দ্র করে চারপাশের মোড়গুলোতেই গুলি চালানো হয়। হতাহত হন অনেকে।

এবার নীরু-অভি গ্রুপ

মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচিতে এরশাদের তখতে তাউশ কেঁপে ওঠে। গোয়েন্দারা নানাভাবে ছাত্রনেতাদের হাত করার চেষ্টা করে। তার মধ্যে যেমন লোভনীয় প্রস্তাব ছিল, তেমনি ছিল হুমকিও। কাউকে পক্ষ বদল করাতে না পেরে এবার ভিন্ন পথ ধরে গোয়েন্দা সংস্থা। কারাগারে ছাত্রদলের যে নেতারা বন্দী ছিলেন, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন সানাউল হক নীরু এবং গোলাম ফারুক অভি। শুরুতেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটা বুঝতে পারেনি। তাই বিশেষ করে নীরুকে তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু পরদিনই তাদের সশস্ত্র অবস্থানে গোটা বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। শুরুতে তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল তাদের এ সশস্ত্র অবস্থান ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হলে সেখানে যেন অন্য সংগঠনগুলো নাক না গলায়। কিন্তু ছাত্রদলের মূলধারাকে সঙ্গে রেখে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নিজেরাও বন্দুক ব্যবহার করে নীরু-অভি গ্রুপকে ক্যাম্পাস থেকে হটিয়ে দেয়। তবে নীরু-অভি বাহিনীর গুলিতে টিএসসিতে নিমাই নামে একজন চা বিক্রেতা নিহত হন।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়

ডা. মিলন এবং জরুরি অবস্থা

পরদিন ছিল ২৭ নভেম্বর। মধুর ক্যানটিন থেকে মিছিল বের করার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যেই হঠাৎ সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিক থেকে গুলির শব্দ। দৌড়ে সেখানে গিয়ে জানা যায়, মিলন নামে একজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তার বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়। তিনি ডা. শামসুল আলম খান মিলন। জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সম্পাদক।

তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ তখনকার পিজি এবং এখনকার বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে যাচ্ছিলেন বিএমএর একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিতে। ছাত্রদের আন্দোলনে তত দিনে পেশাজীবীরাও যোগ দিয়েছিলেন। তারই অংশ ছিল ওই কর্মসূচি। সেটাতে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পাশে তাকে গুলি করা হয়। আততায়ী সেই অভি গ্রুপ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লুকিয়ে ছিল তারা।

ডা. মিলনের নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো ঢাকা ফুঁসে ওঠে। রাস্তায় নেমে আসে হাজারো মানুষ। পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন এরশাদ পতনের ডাক দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে কারফিউ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এরশাদ। তাৎক্ষণিক সাংবাদিকেরা জানিয়ে দেন, জরুরি অবস্থায় সেন্সরড পত্রিকা তারা প্রকাশ করবেন না। 

জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে আবারও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হলে হলে মিছিল করে শিক্ষার্থীরা একযোগে ভিসি ভবন ঘেরাও করে জানিয়ে দেয়, তারা হল ছাড়বে না। বুদ্ধিমান ভিসি মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, ‘বাপুরা, এখন হলে ফিরে যাও। আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি।’

পরদিন এক ভিন্ন ঢাকাকে দেখে সবাই। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা দিনভর বিক্ষোভ করে। শুরুটা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫-২০ জন নারী শিক্ষার্থীর মিছিল থেকে। পরের এক ঘণ্টার মধ্যে তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন নিহত হয়েছেন। তখনো জানতাম না, ওই তালিকায় আমাদের ময়মনসিংহের বন্ধু ফিরোজও আছে। পরদিন ২৯ নভেম্বর ময়মনসিংহ পৌঁছে জানতে পারি, ফিরোজের সঙ্গে জাহাঙ্গীর নামে আরও একজন ছাত্র নিহত হয়েছে।

ওই দিন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল শুধু এ কারণে না যে হলগুলোর দিকে বিডিআরের মেশিনগান তাক করা ছিল। হল ছাড়ার এটাও কারণ ছিল যে বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ডাইনিং-ক্যানটিন, এমনকি হলের পাশে যে দোকানগুলোর বনরুটি-কলা খেয়ে আমরা আগের দিন মিছিল করেছিলাম, তারও কোনো অবশিষ্ট ছিল না। 

এরশাদের পতন

হল ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ায় আন্দোলন সারা দেশেই তীব্রতর হয়। কারফিউ অমান্য করে ঢাকায় চলতে থাকে মিছিল সমাবেশ। ছাত্ররা ছাড়াও যুক্ত হয় বিভিন্ন পেশাজীবী এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। সকলের অংশগ্রহণে আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা বেরিয়ে এসে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনী এরশাদের পক্ষে গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়।

এভাবে টিকে থাকার জন্য সকল দরজা একের পর এক বন্ধ হয়ে গেলে ৩ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন এরশাদ। কিন্তু সকল রাজনৈতিক দল, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এবং অন্যান্য সকল সংগঠন সেটা প্রত্যাখ্যান করলে পরদিন ৪ ডিসেম্বর বিটিভির রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার হয়: ‘হিয়ার ইজ আ ফ্ল্যাশ নিউজ। প্রেসিডেন্ট এরশাদ হ্যাজ ডিসাইডেড টু রিজাইন।’ 

বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা খবরের মাধ্যমে মুহূর্তেই সারা দেশের মানুষ সেটা জানতে পারে। ঢাকাসহ সারা দেশে শুরু হয় বিজয় উৎসব। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০ এরশাদ পদত্যাগ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। শ্রেণিকক্ষে ফিরে গিয়ে জানতে পারি তিনি আমাদের শিক্ষক সিতারা আপার পিতা। সেই সিতারা আপা যিনি বলেছিলেন: ‘একজন স্টুডেন্ট নিহত হয়েছে, আর তোমরা এখনো ক্লাসরুমে!’

ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪

শেষ থেকে যদি শুরু করি, তাহলে বলতে হয় ১৯৯০ সালে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব যে ভুল করেছিল, এবারের সংগঠকেরা সেই ভুল করেননি। তবে এটা ভুল না সঠিক সেটা সময়ই বলে দেবে।

নব্বই সালের সরকারে ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থী হতে চেয়েও দলীয় মনোনয়ন পাননি। শুধু ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব দল বদল করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি।

বিপরীতে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারে সরাসরি ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব আছে। নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ নামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে দুই সমন্বয়কারীর নাম এক মাস আগেও সাধারণে জানা ছিল না, তারা সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। ছাত্রদের দাবি ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। সেটা হয়েছে। নব্বই সালে অবশ্য এ রকম কোনো দাবি ছিল না।

না থাকার থাকার কারণ ওই সরকারের মূল কাজ ছিল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান। এবারের সরকার ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আর সেটা হচ্ছে সংস্কার। এ সংস্কার যেমন রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায়, তেমনি আগামীর সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রশাসন-পুলিশ-বিচার বিভাগ-দুদকসহ সব প্রতিষ্ঠানের।

নব্বই সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যেরও ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব ছিল। পরবর্তী ক্ষমতাসীনেরা তার কিছুই করেননি। এমনকি তিন জোটের যে রূপরেখা ছিল, সেটাও তারা বাস্তবায়ন করেননি। দলগুলোর যে আচরণবিধি করা হয়েছিল সেটাও না।

এবার কি হবে?

ভবিষ্যৎই সেটা বলে দেবে। যেহেতু ১৯৯০ সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের কিছু মিল থাকলেও অমিলও অনেক, তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তখন আন্দোলন শুরুই হয়েছিল আগের ৮ বছরের ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে এক দফা দাবিতে। সেটা ছিল এরশাদের পদত্যাগ। এবার এক দফা এসেছে অনেক পরে।

জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলন শুরুর সময় এটা শুধুই একটা কোটা সংস্কারের বিষয় ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির আন্দোলনের পরিণত হয়। একপর্যায়ে সেটা এক দফা দাবির আন্দোলনে গড়ায়। সঙ্গে যোগ হয় রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি। আওয়ামী লীগ এবং মিত্র দল যেমন হাসানুল হক ইনুর জাসদ ও রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, আওয়ামীপন্থী বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠন অবশ্য শুরু থেকেই বলে আসছিল এটা সরকার পতনের আন্দোলন। 

শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। তবে সরকারের পতনের পর যে হিংসার প্রকাশ দেখা গেছে তার নজির বাংলাদেশ, এমনকি পাকিস্তান আমলের বিবেচনাতেও নেই। এর কারণ কী, এত এত মানুষকে হত্যা! রংপুরে আবু সাঈদকে হত্যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এরপর এ আন্দোলনে রক্ষণশীল হিসাবেও তিন শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই তরুণ-কিশোর। এমনকি ৩২ জন শিশু নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে ইউনিসেফ। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ৮ বছরেও এত মানুষ নিহত হননি, এবার যেটা হয়েছে মাত্র ১৫ দিনে।

এত মানুষের আত্মত্যাগে যে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান, সেটা কি পুরোনো কোনো দলকেই আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবে? নাকি

আসলেই নতুন কোনো যাত্রা করতে পারবে বাংলদেশ? 

আমাদের কানে সব সময় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে: পানি লাগবে?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor