Hot

গত সরকারের বেপরোয়া বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, সাড়ে ১২ লাখ কোটি টাকার দায় ভোক্তার কাঁধে

আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বৈদেশিক ঋণের স্থিতি গত জুন পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার বা ১২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বিগত সরকার এসব ঋণ জনগণ বা ভোক্তার কাঁধে চাপিয়ে গেছে। যা পরিশোধ করতে হবে বর্তমান ও পরবর্তী সরকারগুলোকে। চড়া সুদে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের একটি অংশ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। উন্নয়নের নামে নেওয়া এসব বৈদেশিক ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে। রিজার্ভ কমায় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এতে আমদানি পণ্যসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে লাগামহীন গতিতে। ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। এতে ভোক্তার আয়ের একটি অংশ চলে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির পেটে। সরকারের নেওয়া বৈদেশিক ঋণের চাপ পড়েছে ভোক্তার কাঁধে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসে ২০০৯ সালের শুরুর দিকে। টানা সাড়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময়ে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বেপরোয়া গতিতে সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। আগে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া কঠিন ছিল। বিগত সরকার এই ঋণের নীতিমালা শিথিল করে। বৈদেশিক ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কেড়ে নিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন বিনিয়োগ বোর্ড বা বর্তমানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে কোনো ঝুঁকি বিশ্লেষণ ছাড়াই বেপরোয়া গতিতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে কারণে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি বেড়েছে। এতে রিজার্ভ কমেছে, ডলারের দাম বেড়েছে। যা দেশের অর্থনীতিকে প্রবল সংকটে ফেলেছে। পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে এর সরাসরি চাপ পড়েছে ভোক্তার ওপর। ডলার সংকটে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়ে শিল্পের বিকাশে বিঘ্ন ঘটেছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২ হাজার ২৭৯ কোটি ডলার। গত ৩০ জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলারে। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা হিসাবে) ১২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১২ লাখ কোটি টাকা। ওই সাড়ে ১৫ বছরে সরকার নতুন ঋণ নিয়েছে ৮ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ৩৫৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।

বিগত সরকার ২০০৯ সাল থেকে ঋণ গ্রহণ শুরু করে। ২০২২ সালে এসে পরিশোধের মাত্রা বেড়ে যায়। ওই সময়ে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে ডলারের সংকট দেখা দেয়। তখন রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো হয়। এতে রিজার্ভ কমতে থাকে। বাড়তে থাকে ডলারের দাম। সরকারের সময় ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১৩২ টাকায় উঠেছিল। এখন কমে ১২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৮ হাজার ৩২১ কোটি ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮ হাজার ৪২ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৭৯ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ৫৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯১৭ কোটি ডলার এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে মোট স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ৭ হাজার ৭২৫ কোটি ডলার ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৪৪ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে ছিল ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯১৫ কোটি ডলার। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৩১৫ কোটি ডলার। সূত্র জানায়, ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ডলার সংকট প্রকট হলে সরকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত করে ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। ফলে ঋণের বিপরীতে বাড়তি সুদ দিতে হচ্ছে। সুদের হার বাড়ায় ও টাকার মান কমায় ঋণের স্থিতি আরও বেড়েছে।

মোট ঋণের মধ্যে ৮০ শতাংশেরই সুদের হার বাজারভিত্তিক। অর্থাৎ যখন যে হারে সুদ থাকে তাই পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে ডলারের পরিশোধ করতে হবে বলে ডলারের দাম বাড়লে ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের আগে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। ডলার সংকটের কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করায় এখন দণ্ড সুদ বাড়তি কমিশন দিতে হচ্ছে। ২০২০ সালের আগে কোনো কমিশন দিতে হয়নি। ওই বছরে প্রথম কমিশন দিতে হয় ৬৭ লাখ ডলার। কারণ করোনার কারণে বেশ কিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছিল। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দার কারণে সৃষ্ট ডলার সংকটের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করা হয়। ওই বছরে কমিশন বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে পরিশোধ করতে হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। গত চার বছরে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে কমিশন বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত না করলে বা সময়মতো শোধ করলে কমিশনের অর্থ পরিশোধ করতে হতো না। গত আড়াই বছরে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা। টাকার মান কমায় প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে বেশি দামে, এতে ঋণের বিপরীতে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে আগামী জুনের মধ্যে ১ হাজার ৪১৯ কোটি ডলারের ঋণ শোধ করতে হবে। এ সরকার দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বকেয়া রেখে যাওয়া ঋণের মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ১৮০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। এতে জ্বালানি আমদানির পথ সুগম হয়েছে। গত জুলাই-আগস্টের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেছে ৯৯২ কোটি ডলার। এসব দেনা শোধ করতে রিজার্ভ থেকে ডলার নিতে হয়নি। উলটো এসব দায় পরিশোধ করেও রিজার্ভ বাড়ছে।

সূত্র জানায়, ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার বেসরকারি খাতের ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের স্বল্পমেয়াদি ঋণের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে। ১ বছরের বেশি থেকে ১২ বছরের বেশি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৯১৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১ থেকে তিন বছরের মধ্যে মেয়াদ শেষ হবে ১০২ কোটি ডলার ঋণের। তিন থেকে ৫ বছরের মধ্যে শেষ হবে ৪৪ কোটি ডলার, ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে শেষ হবে ৭১ কোটি ডলার, ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে শেষ হবে ৮০ কোটি ডলার, ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে শেষ হবে ১৪৪ কোটি ডলার ও ১২ বছরের বেশি মেয়াদ রয়েছে ৫৭৪ কোটি ডলারের ঋণের।

বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ১ হাজার ২১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে মূল ঋণ ৯১৫ কোটি ডলার ও সুদ ৩০২ কোটি ডলার। এর মধ্যে চলতি বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে ১৫৩ কোটি ডলার। আগামী বছরে সর্বোচ্চ পরিশোধ করতে হবে ২১৩ কোটি ডলার। এরপর থেকে ঋণ শোধের পরিমাণ কমে আসবে। ২০৪০ সালে পরিশোধ করতে হবে ৪৭ কোটি ডলার।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d