Trending

গরম যেভাবে আমাদের খরচ বাড়িয়ে দিলো

বাড়ি ফিরেও যদি শান্তি হয়! সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতে শরীফুল (নিরাপত্তারক্ষী) বলল, ‘ভাই, পানি কিন্তু নাই। লাইনের কোনো বাড়িতেই নাই। পাম্প ঠিক করতেছে।’ 

শুরুটা হলো চাউল দিয়ে। দেড় বছর আগে পর্যন্ত আমরা মিনিকেট খেতাম। দাম বেড়ে গেলে পাইজাম বা ব্রি-২৮ খাওয়া শুরু করি। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৫ এপ্রিলের পর থেকে আবার ফিরতে হলো মিনিকেটে। কারণ মিনিকেট ফোটাতে সময় কম লাগে, তুলনায় পাইজাম বা আটাশ চাল ফোটাতে প্রায় দ্বিগুণ সময় বেশি লাগে। গরমে চুলার ধারে থাকা ভীষণ কষ্টের, শুধু রান্নাঘর নয়, শোবার ঘর, বসার ঘর সবই তেতে ওঠে। মিনিকেট চাল সরু হয়, খেতেও খারাপ নয়, ভাত দেখায় ধবধবে সাদা। কিন্তু দাম প্রায় ২০ টাকা বেশি। মোজাম্মেলের (ব্র্যান্ড নাম) মিনিকেট আমাদের পাড়ার দোকানি ৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন, যেখানে আটাশ ৬৫ টাকা। 

এত গুণ সত্ত্বেও শুধু দামের কারণেই মিনিকেট এখন আর গলা দিয়ে নামতে চায় না। শুধু মনে হয়, গরম তুহু মম মরন সমান। 

আমাদের তিনজনের পরিবার—স্বামী, স্ত্রী ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া এক ছেলে। সাড়ে ৫০০ বর্গফুটের এক ফ্ল্যাটে থাকি। ফ্ল্যাটটা উত্তরমুখী হওয়ায় বাতাসকে দাওয়াত দিয়েও আনতে পারি না। সরু যে বারান্দাটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, বসার সুযোগ হয় না। দুপুরে বারান্দা দিয়ে তাকালে এখন ধু ধু দেখায়, রোদ খাঁ খাঁ করে। 

মেট্রোরেলের ১০ নম্বর স্টেশন থেকে আমাদের বাসা থেকে হাঁটাপথ। ৬-৭ বছর আগে যখন রেলের পিলার আর স্টেশন নির্মাণের জন্য রাস্তা উল্টে ফেলা হয়েছিল তখনও আমরা মিরপুরেই থাকতাম। রেল হয়ে গেলে সবাই খুব খুশি—সময় বাঁচবে এবার, ভ্রমণ হবে আরামদায়ক ইত্যাদি ভেবে। আমি অবশ্য স্বেচ্ছায় সুবিধাবঞ্চিত রইলাম। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দু-চারবারের বেশি চড়িনি। অফিসে যাওয়া-আসা আগের মতোই বাসে করি। কারণ মেট্রোরেলের ভাড়া বাসের দ্বিগুণ। 

কিন্তু এ সুখও সইল না। গেল ১০-১১ দিন ধরে মেট্রোতে চড়েই অফিস যেতে হচ্ছে, বাসা থেকেও পই পই করে বলে দিচ্ছে, বাসে যেন না যাই। হিটস্ট্রোকের ভয়ে আমি নিজেও অল্পবিস্তর শঙ্কিত। মেট্রোতে চড়া অবশ্য সত্যি আরামদায়ক, দরজাগুলো বড় বড়, ভিড় যতই থাক জায়গা করে নেওয়া যায়, এয়ার-কন্ডিশন থাকায় ঘামতে হয় না। আর সময় তো কম লাগেই। কিন্তু টাকা বেরিয়ে যাওয়ায় মন দিয়ে আরামটা উপভোগ করতে পারছি না।

মেট্রোতে চড়ে নামি গিয়ে কারওয়ান বাজার। ব্যাগে পানির বোতল থাকে। প্রথমে স্টেশনেরই কোথাও বসে তিন ঢোক পানি গলায় ঢেলে নিই। তারপর হেঁটে যাই বাংলামোটর। সেদিন বাধল গোল, ব্যাগে পানির বোতল তুলতে ভুলে গেছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল, সঙ্গে গলাও শুকিয়ে যেতে থাকল। অগত্যা স্টেশন থেকে নেমে ২০ টাকা দিয়ে একটি পানির বোতল কিনে নিলাম। খুব ঠান্ডা পানি খাই না সাধারণত, কিন্তু সেদিন মন চাইছিল। দোকানি অবশ্য বাঁচিয়ে দিলেন, ইতিমধ্যেই ফ্রিজে তোলা সব বোতল বিক্রি হয়ে গেছে। তাই মনকে বোঝালাম, ভালোই হয়েছে, ঠান্ডা খেতে হলো না। ঠান্ডা খেলে কাশি ওঠে, কাশি দমাতে আবার সিরাপ কিনতে হয়। কিন্তু কাশি আমাকে ছাড়ল না, ঘামে দুই দিন এমন ভিজলাম যে সিরাপ কিনেই বাড়ি ফিরতে হলো। গচ্চা ৬৫ টাকা।

বাড়ি ফিরেও যদি শান্তি হয়! সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতে শরীফুল (নিরাপত্তারক্ষী) বলল, ‘ভাই, পানি কিন্তু নাই। লাইনের কোনো বাড়িতেই নাই। পাম্প ঠিক করতেছে।’ 

পানির এই সংকটের সঙ্গে গরমের সম্পর্ক কতখানি ঠিক জানি না। তবে গতবারও একই সময়ে পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। খুব রাগ হলো। ভাড়া তো দিই একগাদা। পানিটাও যদি না পাই তবে আর টাকা দিই কেন। কিন্তু রাগ করে ফায়দা নেই। বরং অটোসাজেশন দিয়ে মেজাজ ঠিক করে নিলাম, শরীফুলকে বললাম, ‘কুছ পরোয়া নেই, পানি ছাড়া কেমন কাটে তার অভিজ্ঞতা সবারই থাকা দরকার। সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে চলার ট্রেনিং হয়ে যাবে।’

পাঁচতলায় উঠতে উঠতে আবার ঘেমে গেলাম। এবার গোসল না করে ৮৫ টাকার মিনিকেটও খাওয়া যাবে না। তবে আসল বিপদ তখনো ঘাপটি মেরে ঘরের ভেতর বসেছিল। ঘণ্টি শুনে ছেলে দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবা খাবার পানিও ফুরিয়ে গেছে। তুমি এখুনি গিয়ে পানি কিনে আনো।’ ঘরে আর ঢোকা হলো না। পাঁচ লিটারের দুটি বোতল নিয়ে ঘরে ফিরলাম। একটি খাব, অন্যটি দিয়ে গোসল সারব। আবার গচ্চা ১৬০ টাকা।

রাতে ঘুমাতে আমাদের এখন দুটি ফ্যান লাগে। আগের বছর চার্জার ফ্যানটি কিনতে হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে। বিদ্যুৎ চলে গেলে তবেই ছাড়া হতো। এবার বিদ্যুৎ বরাবরই ছিল, তবে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে চার্জার ফ্যানটিও সমানতালে চালাতে হচ্ছে। তাতেও যে গরমের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। তবে দুটি না চালালে ঘুমানোই যাচ্ছে না। দিনের বেলাতেও আমাদের সব ঘরের চারটি ফ্যান না চালিয়ে পারা যাচ্ছে না। ফলাফল, মাসের বিদ্যুৎ বিল ১,২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে; আগে ৭০০ টাকাতেই হয়ে যেত।

মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারও আমাদের বাসা থেকে হাঁটাপথ। প্রতিদিন যাই না, যেদিন যাই একটু বেশি বাজার করে নিয়ে আসি। আর যেদিন চাল কিনি, পেঁয়াজ কিনি, আলু কিনি, তেল কিনি, সেদিন রিকশা নিয়ে ফিরতে হয়। ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু এখন এই সময়ে ৩০ টাকা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। রিকশাওয়ালার মুখের দিকে চাওয়া যায় না; ভাবি, এই গরমে রাস্তায় থাকে কী করে। পেটের দায় আসলেই বড় দায়।

বাজারে গেলে ইচ্ছে হয় তরমুজ কিনতে, দাম ৬৫ টাকা কেজি। অথচ রমজান মাসেও ৪০ টাকা কেজি দরে কিনেছিলাম। তালের শাঁস খুব পছন্দ করতাম। সেদিন দাম শুধিয়ে জানলাম, এক কোষ (মোটমাট তিনটি কোষ থাকে) ১৩.৫০ টাকা। এরপর থেকে শুধু চেয়ে চেয়ে পথ চলি, কাছেও ঘেঁষি না। ডাবও খেতে ইচ্ছে হয়, আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেকগুলো নারকেল গাছ আছে, কোনো কোনো দিন দু-তিনটিও খেয়েছি। এই শহরে একটি ডাবের দাম ১০০-১২০টাকা। এর বেলাতেও শুধু শুধু চেয়ে চলে যেতে হচ্ছে।

এর মধ্যে একদিন ছুটির বিকালে মেট্রোতে চড়ে সপরিবারে গেলাম বিমানবাহিনী জাদুঘরে। আগারগাঁওয়ে উন্মুক্ত এ জাদুঘর নির্বাচনের পেছনের কারণ বাতাস। এটি খোলা থাকে রাত ৮টা অবধি। আমরা তাই বিকালের বাতাস আর সন্ধ্যার শান্তিও পাব। টিকিট তিনজনের ৫০ টাকা করে দেড়শ টাকা লাগল। ভেতরে সত্যি সুন্দর বাতাস খেলছে বাদাম বা কামিনী গাছের পাতা ছুঁয়ে। বেশ গোছানোও জায়গাটা। হেলিকপ্টার, ফাইটার প্লেন পেরিয়ে সর্বউত্তরের যে ছোট পার্কটায় বসার বেঞ্চি আছে সেখানে ঢুকতে আবার দিতে হয় ১০ টাকা জনপ্রতি। বেঞ্চে বসে সময়টা ভালো কাটল। ছেলেটা ‘স্লিপারে চড়ল, দোলনায় দুলল, আমরা বাতাস খেলাম। সন্ধ্যা নেমে এলে পরে আমরা গেলাম লেকের দিকে। সেখানে বাতাস কম কিন্তু বাতির রোশনাইয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এক বোতল পানি ছাড়া আর কিছুই খেলাম না আমরা। তাতেই ট্যাঁক থেকে বেরিয়ে গেল, দুই দফা মেট্রো ৬০+৬০= ১২০ টাকা+ জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ১৫০ টাকা + পার্কের প্রবেশপত্র ৩০টাকা + পানি ২০ টাকা=৩২০ টাকা। শুধু বাতাস খেতেই বেরিয়ে গেল ৩২০ টাকা! তবু আমরা খুশি, অনেকদিন পর একটু আরামের বিকাল কাটালাম।

তবে সামনে এক ভয়াবহ পরীক্ষা আসছে, এতে নির্ঘাত ফেল করব। বড় মামাশ্বশুর সেদিন বাসায় ডেকেছিলেন। যেতেই মিষ্টি খেতে দিলেন, নিজের শোবার ঘরে নিয়ে বসালেন, ঘরটা বেশ ঠান্ডা লাগল, এতটা আগে কখনোই লাগেনি। আমি তখনও ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারিনি, মামা সাদা রিমোটটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘গরম লাগছে, আরেকটু কমিয়ে দিব?’ বলতে বলতেই রিমোট টিপলেন, পিপি শব্দ হলো। ঘরে ঠান্ডা বাড়ল। মামা বললেন, ‘তোমার মামির ঘুমাতে কষ্ট হয়, তাই এসিটা কিনেই ফেললাম, দেড় টন, বুঝলে?’

মাথায় তখন ঘুরছে, এবার আমার বাসায়ও দাবি উঠবে, এসি চাই, এসি চাই। কিন্তু আমি কোথায় পাব অত টাকা। তার ওপর বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে। দাবি যখন আন্দোলনে রূপ নেবে, তখন সত্যি পালাতে হবে। গরম তুমি মোরে ঘর ছাড়া করবে, আমি তবু তোমাকে কিছুই করতে পারব না। তুমি এক অদৃশ্য অসহ্য গরম। জীবন পুড়িয়ে দিচ্ছ, কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d