Bangladesh

গরিবের টিসিবি পণ্যে বাড়ছে ‘হকদার’

সয়াবিন তেল ফেরত দিয়ে টাকা নিলেন মনোয়ার হোসেন। বিষণ্ন মুখে ফিরে যাচ্ছেন। পা তাঁর চলছে না, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখনও লাইনে থাকা অসংখ্য মুখে খিস্তি। গরিবের জিনিস নিতেও মানুষগুলোর বিবেকে বাধে না!

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী লিপিকার মোড়ে টিসিবি ট্রাকের সামনে এ ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে। এখানে হযরত এন্টারপ্রাইজ সয়াবিন তেল ও ডাল সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করছে। কথা বলে জানা যায়, মনোয়ার সরকারি চাকরিজীবী। মূল্যস্ফীতির চাপে সত্যিই তিনি অসহায়। বললেন, ‘পেট না চললে, বিবেক দিয়ে কী করব? কিন্তু হাত থেকে যখন মানুষ তেল কেড়ে নেন, কিছু করার থাকে না। বাধ্য হয়ে টাকা ফেরত নিয়েছি।’

বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতি চললেও আয় বাড়েনি মানুষের। ফলে সংসার সামাল দিতে মনোয়ারের মতো অসংখ্য মানুষ এখন টিসিবির পণ্য কিনছেন। এখানে আর গরিব বলে আলাদা করার সুযোগ থাকছে না। অনেক বাড়ির মালিক গৃহকর্মী পাঠিয়ে পণ্য কিনছেন।

টিসিবি দিনে জনপ্রতি ২ লিটার সয়াবিন তেল ও ২ কেজি মসুর ডাল বিক্রি করে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০ এবং প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম নেয় ৬০ টাকা। বাজারে এখন সয়াবিন তেল ১৭৫ এবং মসুর ডালের কেজি ১০৫-১১০ টাকা। পরিবারের একজন পণ্য দুটি কিনলে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা সাশ্রয় হয়। সদস্য বৃদ্ধি করলে বাড়ে সাশ্রয়ের অঙ্কও। এ জন্যই ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাকের অপেক্ষায় থাকছেন বহু মানুষ। বিক্রি শুরুর পর রীতিমতো ‘যুদ্ধে’ শামিল হচ্ছেন তারা।

টিসিবি কর্মকর্তারা জানান, দিনে প্রতিটি ট্রাকের মাধ্যমে ৮০০ কেজি ডাল ও ৮০০ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন তারা। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৪০০ জন পণ্য কিনতে পারছেন। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ৫০টি ট্রাকের সুবিধাভোগী বড়জোর ২০ হাজার। তাও ডিসেম্বর থেকে সরবরাহ না থাকায় চাল, আটা, আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রামপুরা টিভি সেন্টার, হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজ, চৌধুরীপাড়া পেট্রোল পাম্প, জাতীয় প্রেস ক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারা, মৎস্য ভবন, বেগুনবাড়ী, সাতরাস্তাসহ অন্তত ১০ স্পট সরেজমিন ঘুরে দেখার সময় কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় অর্ধেক মানুষ পণ্য পাচ্ছেন না। নির্দিষ্ট সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ায় একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। প্রায় সবখানে দেখা যায়, ক্রেতাদের মধ্যে শৃঙ্খলা রাখতে ট্রাকের কর্মীরা মার্কার দিয়ে সিরিয়াল নম্বর হাতে লিখে বসিয়ে রাখছেন।

বেগুনবাড়ীর লিপিকার মোড়, বিকেল প্রায় ৩টা। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে টাকা নিয়ে লাইনে আছেন ১৭২ সিরিয়ালে ষাটোর্ধ্ব রওশন আরা বেগম। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্তি আসায় লাইনেই বসে পড়লেন। তখনও তাঁর সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয় লাইনে অন্তত ৪২ জন। হঠাৎ বিক্রয়কর্মী বলে উঠলেন, ধাক্কাধাক্কি করে লাভ নেই। মাত্র ছয়জন নিতে পারবেন। শুনেই দাঁড়িয়ে যান রওশন আরা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ট্রাকের কাছে এসে নাতির বয়সী বিক্রয়কর্মীর পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। বলেন, ‘বাবা, আইজকা কাম বাদ দিয়া আইছি। আমারে ফিরাইও না। কেউ নাই আমার বাবা।’ কাজও হয়। মন গলে যাওয়ায় অন্যদের তোপে পড়েও বৃদ্ধার হাতে তুলে দেন সয়াবিন তেল ও ডাল। রওশন আরা ফিরে যান তৃপ্তি নিয়ে। কিন্তু বাকি অনেককেই ফিরতে হয় বিষণ্ন বদনে।

টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির সমকালকে জানান, সক্ষমতা অনুযায়ী তারা পণ্য দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয় সরবরাহ না করায় চাল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। আর নিয়ম অনুযায়ী বাজারে আলু ও পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি করা হচ্ছে না।

সাতরাস্তা মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাক, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সোয়া ৩টা। সয়াবিন তেলের বোতল আছে ১২টি। কিন্তু তখনও ৩৭ নারী-পুরুষ লাইনে। বিক্রয়কর্মী মো. বিপ্লব বললেন, আর ১০ জন পাবেন। এর পরই সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহবুব হাসান বললেন, বেগুনবাড়ীতে শেষ হয়ে যাওয়ায় দৌড়ে এখানে এলাম। পেলাম না। দিনটিই মাটি।

রামপুরা টিভি ভবনের বিপরীতে ইউটার্নের পাশে কাপড়ের ব্যাগ হাতে বসে চোখ মুচছেন আসমা বেগম। পাশেই টিসিবির পণ্য বিক্রি শেষ হওয়ায় চলছে হুলস্থূল। বুঝতে বাকি নেই আসমার কান্নার কারণ। বললেন, ‘হেই সকাল ১০টা আর ১২টার দুই বাসার কাম বাদ দিয়া আইছি। এরুম ধাক্কাধাক্কি করে সবাই, আমি পইড়া হাঁটুত ব্যথা পাইছি। না পাইরলাম নিতে কিছু, না কইরলাম দুই বাসার কাম।’
এখানে টিসিবির পণ্য বিক্রেতা বশির উদ্দিন জানান, ৪০০ জনকে দেওয়ার পর কিছুই করার থাকে না তাদের। গাড়ি দেখে সবাই আসে। আগে থেকে জানানো হয় না।
এখানে স্কুলপড়ুয়া সবুজ মিয়া বলে, ‘মা অসুস্থ থাকায় মাইনষের বাসায় কামে যায় নাই। আমারে কিনতে পাঠাইছে। বড় বড় মাইনষের জন্য টেরাক নাগালেই পাই না। আইজ খালি হাতে বাড়ি গেলে খাওন জুটব না।’

হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজের পাশে টিসিবি ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। রোড ডিভাইডারেও বসে অনেকে। কয়েকজন জানান, বিক্রি শুরু হয়েছে সকাল ১০টার কিছু আগে। দুপুরেও অনেকে পণ্য পাননি। দিনমজুর খায়রুল ইসলাম ও আম্বিয়া বেগমের অভিযোগ, ‘মগবাজার আমবাগান ও গাবতলায় টেরাক আহে না। এদিকেও আহে ম্যালা দিন পর পর। আমগোর আইতে কষ্টও হয়, সময়ও নষ্ট হয়। দেহেন, আইজকা কুনু কাম করতে পারলাম না। খাড়ায়া থাইকা ঠ্যাং ধইরা গ্যাছে গা। হাতে নম্বর লেইখ্যা কাগজ ধরায়া দেয়, পণ্য দেয় না।’

টিসিবির পণ্য নিতে এখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাও ভিড় করছেন। মধ্যবিত্তরা মাস্ক, মাফলার মুখে পেঁচিয়ে লাইনে থাকছেন। উচ্চবিত্তরা বাসার দারোয়ান, গৃহকর্মী ও অন্যদের পাঠাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, সরকারি চাকরিজীবী হলেও, এখন টিসিবির পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছি। অফিসে না গিয়ে সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় মিথ্যা বলে এসেছি, জরুরি কাজে যাচ্ছি। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই ট্রাক থেকে পণ্য কিনছি। নিজেকে খুব অসহায় লাগে।

মধুবাগে হাতে মার্কার কলম দিয়ে সিরিয়াল লিখে দিচ্ছেন বিক্রেতা মাসুদ পারভেজ। পণ্য দিয়ে নম্বর কেটে দেওয়া হচ্ছে। ১২ বছরের কিশোর শান্ত এক বাসায় কাজ করে। ভাড়াটিয়া তাকে টিসিবির পণ্য কিনতে পাঠিয়েছেন। শান্তর সঙ্গে তার বয়সী আরও কয়েকজন একই উদ্দেশ্যে এসেছে। আশপাশের বাসা থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে। এসব ছেলের ভাষ্য, শুধু ভাড়াটিয়া নন, বাড়ির মালিকও টিসিবির পণ্য কিনছেন। তারা দারোয়ান ও গৃহকর্মীকে পাঠান। এ সময় ষাটোর্ধ্ব করিমন নেছা বলেন, ‘আইজকা এই লেইখ্যা দেওনের সিস্টেমটা অনেক ভালা। পরশু (মঙ্গলবার) পল্লীমা স্কুলের সামনে মারামারি লাইগ্যা গেছিল। ওইহানে নম্বর ছিঁড়া ফালায়া আবার আইসা নিত।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে টিসিবির পণ্যের সরবরাহ ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি। প্রয়োজনে এডিপির অব্যবহৃত অর্থ ব্যয়ে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এ দেশে রমজানে সবকিছুর দাম বাড়ে। এ জন্য সরকারকে এখনই প্রস্তুতি রাখতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। বাজারে পণ্যের দর বেশি থাকায় মানুষ টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটছেন। ফলে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। প্রয়োজনে মাঝারি মানের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে এলসি খুলতে সহায়তা করে টিসিবির পণ্য আমদানি করা যেতে পারে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। এম এ রাজ্জাক মনে করেন, টিসিবির জন্য নতুন সরকারের কোনো বাজেট নেই। ফলে তারা এডিপির অব্যবহৃত কিছু অর্থে টিসিবির সক্ষমতা বাড়ালে বহু মানুষ উপকৃত হবেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d