Bangladesh

গরিবের প্রকল্প সচ্ছলদের পেটে

সমাজের দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া নারী-পুরুষদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হতদরিদ্ররাই ছিলেন পিছিয়ে। এ প্রকল্পের অধীনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী, আর্থিকভাবে তারা হয় উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত। যেই জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এ প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তারাই ব্রাত্য। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাক্সিক্ষত জনগোষ্ঠী প্রশিক্ষণ না পাওয়াটা প্রকল্পের অর্থের অপব্যয়।

দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী বিটাক ২০২০ সালের অক্টোবরে ১২৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি শুরু করে। এর মূল লক্ষ্য হলো সমাজের একেবারেই দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত ৭ হাজার ৪৪০ জন পুরুষ ও ৭ হাজার ৫৬০ জন নারীকে কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা। ‘হাতে কলমে কারিগরি প্রশিক্ষণে মহিলাদের গুরুত্ব দিয়ে বিটাকের কার্যক্রম সম্প্রসারণপূর্বক আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প (ফেজ-২)’ শীর্ষক এ প্রকল্পটির পর্যালোচনা করেছে আইএমইডি।

প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল মেইনটেইনেন্স, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, মোবাইল সার্ভিস, ওয়েল্ডিং, মেশিন শপ, প্লাস্টিক প্রসেসিং (কাস্টমাইজড), অটোক্যাড, হ্যান্ডিক্রাফট, প্লাস্টিক প্রসেসিং, হাউজহোল্ড অ্যাপ্লায়েন্স।

এ প্রকল্পে ১৫ হাজার প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে ব্যয় হবে ৫৪ কোটি টাকা, এটি মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৪৩ শতাংশ। প্রশিক্ষণার্থীদের যাতায়াত ভাতায় ব্যয় হবে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি পাঁচ জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে প্রশিক্ষণার্থীরা গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন। তবে শুধু চাঁদপুর কেন্দ্রে কোনো নারী প্রশিক্ষণার্থীর লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়নি।

আইএমইডি পর্যবেক্ষণে দেখতে পায়, প্রকল্পটি স্বল্পশিক্ষিত ও দরিদ্রদের উদ্দেশ্য নিয়ে করা হলেও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মূলত স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা। আইএমইডি বলছে, বাস্তবে সমাজের দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া নারী-পুরুষের চেয়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি হয়েছে। ফল পাওয়া গেছে উল্টো। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি নেন, কিন্তু চাকরি পছন্দসই না হওয়ায় তারা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সেসব চাকরি ছেড়ে চলে যান।

প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার উদ্দেশ্যে ২৫০ জন উপকারভোগীর কাছ থেকে সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ১০টি এফজিডি, ২৫ জন মুখ্য ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, ১০টি কেস স্টাডি ও প্রধান প্রধান কার্যক্রমের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

উত্তরদাতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত বা স্নাতক ডিগ্রিধারী। এফজিডি ফলাফলেও উঠে এসেছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, যাদের প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা সেই প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ স্নাতক পাস, ১২ শতাংশ স্নাতকোত্তর, এইচএসসি পাস ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ, এসএসসি পাস ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ডিপ্লোমা পাস ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

এসব উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে প্রশিক্ষণের পর প্রায় শতভাগই সনদ পান। কিন্তু ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ মনে করেন এ সনদ তাদের কোনো কাজেই আসছে না।

অর্থ-বছরভিত্তিক প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দ, অর্থ ছাড় ও ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের মোট আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে শতকরা ৪১ দশমিক ৭৬ ভাগ এবং ভৌত অগ্রগতি শতকরা ৪১ দশমিক ৭১ ভাগ।

আইএমইডির এসব পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ইকবাল হোসেন পাটোওয়ারী বলেন, ‘পর্যবেক্ষক দলের মিটিংয়ে আমিও ছিলাম। তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, আমরা প্রতিবাদও করেছি। তারা এটি কোনো তথ্যভিত্তিক কথা বলছেন না। বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়। এ সংখ্যা খুব বেশি সংখ্যক নয়। দুই-একজন হয়তো শিক্ষাগত যোগ্যতা লুকিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছেন। যারা এভাবে ভর্তি হয়েছেন, তারা ডিগ্রি বা স্নাতক পাস হয়েও বলেন ম্যাট্রিক পাস।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটাও ঠিক, আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত অনেকেই চাকরি পান না। তাদের কিছুসংখ্যক এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যান।’

এ প্রকল্পের মাধ্যমে চার অর্থবছরে ২ হাজার ৯৮০ জন নারী ও ২ হাজার ২৩৭ জন পুরুষকে চাকরির আওতায় আনার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাকরি পেয়েছেন ১ হাজার ৭৬৮ জন নারী ও ১ হাজার ১১৭ জন পুরুষ।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি (অর্থ বছরভিত্তিক) এবং অবশিষ্ট সময়ে অবশিষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান কষ্টসাধ্য হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ রয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ১৫ হাজার নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছর পর্যন্ত প্রশিক্ষণের আওতায় এসেছেন মাত্র ৫ হাজার ৩৫৩ জন। বাকি অর্থবছরে অবশিষ্ট প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে করে আইএমইডি।

এ প্রসঙ্গে পিডি ইকবাল হোসেন পাটোওয়ারী বলেন, ‘যেহেতু আইএমইডি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, আমরা সেই পর্যবেক্ষণের আলোকে বাকি সময়ে কাজগুলো করার চেষ্টা করব।’

সরকারের এ পরিবীক্ষণ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এ প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিতদের নিরুৎসাহিত করে স্বল্পশিক্ষিত ও গরিব প্রশিক্ষণার্থীদের অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতের পাশাপাশি ম্যধবিত্ত পরিবারের প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রচারণার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

প্রকল্পে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অবহেলা লক্ষ করেছে পর্যবেক্ষক দল। চাকরিপ্রাপ্তদের সংখ্যা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সংখ্যা থেকে কম প্রতীয়মান হয়েছে পরামর্শক দলের কাছে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ শেষে প্রাপ্ত চাকরিতে যোগদানের পর তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তরা প্রশিক্ষণ শেষে এসব চাকরি করতে চান না কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেসব প্রশিক্ষণ তাদের সনদের সঙ্গে জুতসই হয় না। এ কাজগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত স্বল্পশিক্ষিতরাই করে থাকেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, স্বল্পশিক্ষিতদের কাজের প্রশিক্ষণ উচ্চশিক্ষিতদের দেওয়াটা প্রকল্পের অর্থের অপব্যয়।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটা আমাদের বড় সমস্যা, যাদের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় আমরা তাদের রিচ করতে (খুঁজে বের করা) পারি না। অনেক সময় দেখা যায়, যারা সুবিধা পাওয়ার কথা তারা পাচ্ছেন না। যারা পাওয়ার কথা তারা বাইরে থেকে যাচ্ছে, যারা পাওয়ার কথা না তারা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ কারণে আমাদের সীমিত সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফল পেতে দেয় না।’

ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এগুলো নিয়ে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। যারা সিলেক্ট (নির্বাচন) করছে, তাদের ওপর নজরদারিও রাখা উচিত। নজরদারির অভাব থাকলে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। যারা করছে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষ আছে, এসব ত্রুটি শনাক্তের জন্য আইএমইডির পর্যবেক্ষণের অপেক্ষা করতে হবে কেন। ঠিকমতো সিলেকশন হচ্ছে কি না, এটা সুপারভাইজারদের দেখার কথা।’

কারিগরি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরও উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি তা নয়, অনেকে চাকরি করেন, অনেকে করেন না। আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের জন্য এর বাইরে কী করতে পারি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোক ডেকে তাদের জব (চাকরি) দিয়ে দিই, এরপর কে কোথায় যায়, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন না। তারা যোগাযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি।’

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষিতরা এসব কাজ করবে না এটাই তো স্বাভাবিক। তারা চাকরি করছে না, এটাই আমাদের প্রকল্পের অর্থের অপব্যয়, অপচয়। লক্ষ্য নির্দিষ্টভাবে কাজ না করার কারণে এসব বিচ্যুতি হচ্ছে। প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।’

পর্যবেক্ষক দল বলছে, প্রকল্পের প্রস্তাবনাতেই (ডিপিপি) গলদ রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কোনো টেকসইকরণ পরিকল্পনা নেই। প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিপ্রাপ্তদের তথ্য সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হলেও তাদের ট্র্যাকিংয়ের (নজরদারি) কোনো সফটওয়্যার নেই।

বিটাকের পাঁচটি কেন্দ্র থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ হাজার ৯৮০ জন নারী (৫৮.০৯%) এবং ২ হাজার ৩৭৩ জন পুরুষসহ (৪৮.২৩%) ৫ হাজার ৩৫৩ জন প্রশিক্ষণার্থীকে (৫৩ দশমিক ২৬ শতাংশ) প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button