Hot

গর্বের রিজার্ভ টিকল না চার মাসও, ২০২১’র ফেব্রুয়ারিতে ৪৮০৬ কোটি ডলার

আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ দ্রুতই ঝুঁকিতে চলে যায় * বাড়িয়ে দেখানোর কারণে নিট রিজার্ভ ছিল কম

২০০২ সালের শুরু থেকে টানা ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৯ বছর আট মাস। ওই সময়ে দেশের শাসনভার ছিল বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। আলোচ্য সময়ে দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোয় অনেক উত্থানপতন ঘটেছে। তবে একটি সূচক সর্বদাই গড়ে ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সেটি হলো দেশের বৈদেশিক গ্রস মুদ্রার রিজার্ভ। ১০০ কোটি ডলারের কম থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এ নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যেও তৃপ্তির ঢেকুর কম ছিল না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার রিজার্ভকে অর্থনৈতিক আলোচনার টেবিল থেকে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে। তাদের আমলে রিজার্ভ বেশি বাড়ায় গর্ব করে দলের নোতারাও রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করতে ভুল করেননি। রিজার্ভ নিয়ে সফলতার গল্প দেশবাসী শুনে অনেকের মধ্যেই একটি আশার বাণী সঞ্চার করেছিল-রিজার্ভ নিয়ে আর ভাবতে হবে না।

যে কোনো সংকটে এই রিজার্ভ দিয়ে উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেড় মাসও টিকল না সেই গর্বের জায়গাটি। দ্রুত কমতে থাকল। চার মাসের মাথায় সরকারকে ভাবিয়ে তুলে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি। সরকার দ্রুত আইএমএফ-এর কাছে ঋণ সহায়তা চায়। এর ধারাবাহিকতায় নিট রিজার্ভ এখন কমে ২ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার শেষ মুহূর্তে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। পরবর্তী সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ সংকটের কারণে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে এক কিস্তির দেনা পরিশোধ স্থগিত করে ঋণ হিসাবে ৩৯ কোটি ডলার নেয় আকুর কাছ থেকে। পরের কিস্তিতে তা পরিশোধ করে।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রাজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। ২০০১ সালের শেষদিকে গ্রস রিজার্ভ ছিল ১৩০ কোটি ডলার। ২০০৬ সালে দলটি ক্ষমতা ছাড়ার সময় রিজার্ভ ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। রিজার্ভ বেড়েছিল ২ দশমিক ৬৮ গুণ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ বাড়িয়েছে। ২০০৮ সালে তারা ৭০০ কোটি ডলার রিজার্ভ রেখে যায়। ওই দুই বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ২ গুণের বেশি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে রিজার্ভ বাড়ানোর জোরালো পদক্ষেপ নেয়। তাদের সময়ে ২০১০ সালের জুনে রিজার্ভ প্রথম এক হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০১৪ সালের জুনে ২ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০১৬ সালের জুনে ৩ হাজার কোটি ডলার এবং ২০২০ সালের অক্টোবরে ৪ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০২১ সালের আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ। আওয়ামী লীগ সরকারের ওই ১৩ বছরে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। রিজার্ভ বাড়ায় সরকারের পক্ষ থেকে অনেক গর্ব করা হয়। তীব্র সমালোচনাকে উপেক্ষা করে রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে থাকে। তবে তা কমছিল খুবই ধীরগতিতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।

এতে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। ফলে ডলার খরচ বেড়ে যায়। চাপে পড়ে ডলার। এর দাম বাড়তে থাকে। ওই মাসে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ছয় মাসে রিজার্ভ কমেছিল ২১১ কোটি ডলার। বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ায় ওই বছরের মার্চে ৯৫১ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। যে কারণে রিজার্ভ আরও চাপে পড়ে যায়। এ চাপ কমাতে এবং রিজার্ভ সাশ্রয় করতে ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করে। এতেও রিজার্ভের নিম্নগতি রোধ করা সম্ভব না হলে এক মাসের মাথায় এলসি মার্জিন আরও বাড়িয়ে দেয়। ১০ মে থেকে বিলাসী পণ্যে ৭৫ শতাংশ ও বাণিজ্যিক পণ্যে ৫০ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। এর ৫৫ দিনের মাথায় ৫ জুলাই বিলাসী পণ্যে শতভাগ মার্জিন আরোপ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে ঋণ বন্ধ করে দেয়। ওই বছরের জুলাইয়ে রিজার্ভ নেমে আসে ৩ হাজার ৯৬০ কোটি ডলারে। ৫ মাসে রিজার্ভ কমে যায় ৬৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গর্বের রিজার্ভ টিকল না চার মাস। এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের রিজার্ভ ঝুঁকিতে চলে যায়। এখনো রিজার্ভ নিম্নমুখী। গত ১২ জুন গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৫২ কোটি ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯২১ কোটি ডলার। প্রায় তিন বছরে দেশের গ্রস রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ হচ্ছে বিপদে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু রিজার্ভ বাড়ায় সরকার এর অপব্যবহার শুরু করে। একদিকে অপব্যবহার করে রিজার্ভ ক্ষয় করেছে, অন্যদিকে এসেছে মন্দা। এ দুইয়ে মিলে রিজার্ভ সংকট প্রকট হয়েছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে ডলারের দাম এত বাড়ত না। পণ্যের দামও এত আকাশচুম্বী হতো না। মূল্যস্ফীতিও হতো না এত ঊর্ধ্বমুখী। এখন যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশ, এর সূত্রপাত হচ্ছে সুশাসনের অভাব এবং রিজার্ভ সংকট থেকে। এছাড়া বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবও রয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে সরকার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আইএমএফ-এর ঋণ চায়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে দুটি কিস্তিতে ১১৬ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এতে রিজার্ভের বেশি উন্নতি হয়নি। তবে সাময়িক উপশম হয়েছে। ২৫ বা ২৬ জুন তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে।

রেকর্ড রিজার্ভ দিয়ে ওই সময়ে প্রায় ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। কিন্তু তা তিন মাসের মধ্যেই কেন ঝুঁকির পর্যায়ে নেমে গেল, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আইএমএফও সরকারের রিজার্ভের ওই হিসাব মানতে নারাজ। তারা বারবার নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেনি দীর্ঘ সময়। গত বছরের জুলাই থেকে নিট হিসাব প্রকাশ করলেও এটিও আইএমএফ মানতে নারাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯২১ কোটি ডলার। কিন্তু আইএমএফ মনে করে এ থেকে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক দেনা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বাদ দিতে হবে। এগুলো বাদ দিলে নিট রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের মতো। ওই সময়ে রিজার্ভের হিসাব বাড়িয়ে দেখানো হলেও নিট রিজার্ভ কম ছিল। যে কারণে রিজার্ভ কমতে থাকায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে সরকারের মধ্যেও রিজার্ভ নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছিল। সরকার এখনো অস্থির। রিজার্ভ বাড়াতে এখন বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor