গাজাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সময় লাগবে ৮০ বছর
জাতিসংঘ বলেছে, গাজাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৮০ বছর সময় লাগবে। এদিকে অবরুদ্ধ গাজায় আবারও ত্রাণ তত্পরতা শুরু করতে প্রবেশ করেছে ৪০০ ত্রাণবাহী ট্রাক। অন্যদিকে ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। এছাড়া পশ্চিম তীরে শিশু হত্যায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে যদি গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি হয় এবং স্বাভাবিক গতিতে সেখানে ঘরবাড়ি, হাসপাতাল-পরিষেবাকেন্দ্র, রাস্তাঘাট ও আগেকার অন্যান্য অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয় সেক্ষেত্রে উপত্যকাকে ৭ অক্টোবরের হামলার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সময় লাগবে ৮০ বছর। যদি পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের কাজের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি উন্নীত করা হয়, তাহলেও উপত্যকাকে আগের মতো বসবাসযোগ্য করে তুলতে ২০৪০ সাল পেরিয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বিষয়ক প্রকল্প ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি)। সেখানে এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর গত সাত মাসের গোলা ও বোমা বর্ষণে নজিরবিহীনভাবে তছনছ হয়ে গেছে গাজা। উপত্যকার অন্তত ৮০ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং গোটা উপত্যকায় দারিদ্র্য বেড়েছে ভয়াবহভাবে। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে অবশ্য গাজার ভবনগুলো পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি জনগণের আর্থিক অবস্থাকেও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিকেও ধরা হয়েছে।
ইউএনডিপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা অ্যাশিম স্টেইনার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অভূতপূর্ব মাত্রার প্রাণহানি, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং দারিদ্র্যের ব্যাপক উল্লম্ফনের কারণে গাজায় সার্বিক যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা স্বল্প সময়ের মধ্যে কাটিয়ে ওঠা একেবারেই সম্ভব নয়। এই যুদ্ধ গাজার আগামী কয়েক প্রজন্মের ভবিষ্যেক বিপদে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবেদনে ইউএনডিপি বলেছে, যুদ্ধের মধ্যে ২০৩০ সালের ডিসেম্বরে গাজার মোট জনসংখ্যার মধ্যে দরিদ্রের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে যুদ্ধ ছয় মাস পেরিয়ে সাত মাসে পা দিয়েছে; যদি ৯ মাস পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে, তাহলে গাজায় দরিদ্রদের হার পৌঁছাবে ৬০ দশমিক ৭ শতাংশে। এর অর্থ, যুদ্ধ আর দুই মাস অব্যাহত থাকলে গাজায় মধ্যবিত্ত বলে কোনো শ্রেণির অবস্থান আর থাকবে না, প্রতিবেদনে বলেছে ইউএনডিপি। এদিকে এর আগে বুধবার জাতিসংঘের আরেক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (ইউএনমাস) জানায়, রুশ বাহিনীর গত দুই বছরের অভিযানে ইউক্রেনে যত ধ্বংসস্তূপ হয়েছে, গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গত সাত মাসের অভিযানে যে পরিমাণ ধ্বংস্তূপ জমেছে, তা ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর গত দুই বছরে জমা ধ্বংস্তূপকে ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে গাজায় ৪০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার ইসরাইলি সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয়কারী সংস্থা ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দেয়। এক এক্স বার্তায় সংস্থাটি জানায়, উত্তর গাজায় বিমান থেকে মানবিক সহায়তা দেওয় হয়েছে। পাশাপাশি ২২ ট্রাক ত্রাণ উত্তর গাজায় সরবরাহ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, এপ্রিলে প্রতিদিন গড়ে ১৬৩টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দিয়েছে ইসরাইল। তবে ইসরাইল যে সংখ্যক ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। কারণ অবরুদ্ধ এলাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক দরকার।
অন্যদিকে গাজায় ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় নিরবছিন্ন মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। ২০২৩ সালে তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এতে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে স্বৈরশাসকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর আগে সীমিত পরিসরে ইসরাইলের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু এবার পুরোপুরিভাবে বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিল এরদোয়ান প্রশাসন। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, তার সরকার ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। গাজায় চালানো ধ্বংসযজ্ঞের কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
এদিকে পশ্চিম তীরে শিশু হত্যার ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে। গত বছর ২৯ নভেম্বর বিকালে কয়েক জন ফিলিস্তিনি বালক অধিকৃত পশ্চিম তীরের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। যেখানে তারা প্রায়ই একসঙ্গে মিলে খেলত। কয়েক মিনিট পরই ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে তাদের দুই জন বাসিল (১৫) ও আদম (৮)-এর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সামরিক দখলদারিত্বে থাকা পশ্চিম তীরে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণ নিয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে বিবিসি দুই বালককে হত্যার ঐ দিনে কী ঘটেছিল তা খুঁজে বের করেছে। তাদের অনুসন্ধানে মোবাইল ফোন, সিসিটিভি ফুটেজ, ইসরাইলি সেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, ঘটনাস্থলের বিস্তারিত তদন্তসহ সব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। এতে বেরিয়ে এসেছে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ। জাতিসংঘের মানবাধিকার ও সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ দূত বেন সৌল বলছেন, আট বছর বয়সি বালক আদম হত্যা ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলেই মনে হচ্ছে। আরেক আইন বিশেষজ্ঞ ড. লরেন্স হিল-কথর্ন গুলি চালানোকে ‘নির্বিচারে প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার’ বলেছেন। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভাঙচুর, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের অস্ত্রের ভয় দেখানো, এলাকা ছেড়ে পাশের দেশ জর্ডানে চলে যেতে বলা এবং সশস্ত্র এক ফিলিস্তিনির লাশ ছিন্নভিন্ন করার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
২৯ নভেম্বরের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বাসিল একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং দোকানের শাটার বন্ধ। যখন ইসরাইলি সেনারা আসে, তখন পশ্চিম তীরের জেনিন শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড হলেও সেখানে গাজার মতো হামাসের শাসন নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, জেনিন শরণার্থী শিবিরের খুব কাছ থেকে ইসরাইলি সেনা অভিযানের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ফুটবল পাগল ও লিওনেল মেসির ভক্ত আদম তার ১৪ বছর বয়সি বড় ভাই বাহার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তায় মোট ৯ জন ছেলে ছিল, সবাইকেই সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল। এ ক্যামেরাতেই পরে কী ঘটেছিল তার প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়।
কয়েক শ মিটার দূরে অন্তত ছয়টি ইসরাইলি সাঁজোয়া যানের বহর মোড় ঘুরিয়ে ছেলেদের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এতে ছেলেরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কয়েক জন ছেলে দৌড়ে সরে যেতে শুরু করে। ঠিক সে সময়েই একটি মোবাইল ফোনের ফুটেজে দেখা যায়, একটি সাঁজোয়া গাড়ির দরজা সামনের দিক থেকে খুলে যায়। এর ভেতরে থাকা সেনা সরাসরি বালকদের দেখতে পাচ্ছিল। রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিল বাসিল। সেনাদের থেকে ১২ মিটার দূরে ছিল আদম। সে দৌড়াচ্ছিল। এরপরই অন্তত ১১টি গুলির শব্দ হয়। ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে বিবিসি দেখতে পায়, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এসব গুলি আঘাত হেনেছে। চারটি গুলি একটি ধাতব খুঁটিতে আঘাত করে, দুটি হার্ডওয়্যার স্টোরের শাটারে, একটি গুলি পার্ক করে রাখা একটি গাড়ির বাম্পারের ভেতর দিয়ে চলে যায়। আরেকটি গুলি আঘাত করে সিঁড়ির হাতলে।