‘গাজার রক্তে রঞ্জিত পশ্চিমা মিডিয়ার হাত’
গত পাঁচ মাস ধরেই বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে এতদিন যা লুকানো ছিল তা দিনের আলোয় চলে আসছে। পশ্চিমারা এতদিন মরিয়া হয়ে হামাসকে দুষ্ট, ধূর্ত এক গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছে । কিন্তু পশ্চিমারা কি আদৌ বিশ্বাস করে যে, ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে লক্ষাধিক শিশুকে হত্যা, পঙ্গু এবং এতিম করা হয়েছে? পশ্চিমা জনসাধারণকে কীভাবে ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে তা বোঝার জন্য কিছু সংবাদপত্রের কভারেজ তুলে ধরা হলো-
‘উত্তর গাজার শিশুরা অনাহারে কাঁপছে’
দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস তার শিরোনামে লেখে, ‘উত্তর গাজার শিশুরা অনাহারে কাঁপছে’। কিন্তু এটি গাজার সমস্যা নয়। ইসরাইল সচেতনভাবে গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত রেখেছে। তারা এমন নীতি নিয়েছে যার ভয়াবহ মূল্য চোকাতে হচ্ছে গাজার মানুষকে। ফিলিস্তিনিদের জন্য মেডিকেল এইডের প্রধান গাজা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন , ‘এখানে শিশুরা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম হারে ক্ষুধার শিকার হচ্ছে’ । গত সপ্তাহে ইউনিসেফ ঘোষণা করেছে যে, উত্তর গাজার দুই বছরের কম বয়সী এক তৃতীয়াংশ শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এর নির্বাহী পরিচালক, ক্যাথরিন রাসেল স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন , ‘অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি শিশুদের জীবন বাঁচানোর এবং তাদের দুর্ভোগ শেষ করার একমাত্র পথ হতে পারে’ ।
কিন্তু এসব জেনেও পশ্চিমারা নীরব থেকেছে। পশ্চিম শক্তিহীন নয়। তবুও মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধকে তারা আটকায়নি দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ইসরাইলকে শাস্তি দিতে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে অস্বীকার করেছে। শুধু তাই নয়, ছিটমহলের প্রধান মানবিক লাইফলাইন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-কে অর্থায়ন প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ইসরাইলকে গাজার শিশুদের অনাহারে রাখতে সহায়তা করেছে।কিন্তু খবরের শিরোনামে এসব কিছুই আসেনি। এসেছে শুধু দুটি লাইন – গাজার শিশুরা ক্ষুধার্থ ‘।
এই ধরনের ভুল খবর সর্বত্র রয়েছে – এবং এটি সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছাকৃত। এটি একটি প্লেবুক যা প্রতিটি পশ্চিমা মিডিয়া আউটলেট দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। গত মাসে যখন একটি ত্রাণবাহী কনভয় গাজা শহরে পৌঁছেছিল তখন এটি দৃশ্যমান ছিল, যেখানে ইসরাইল-প্ররোচিত দুর্ভিক্ষের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। ইসরাইল ত্রাণবাহী কনভয় থেকে খাবারের পার্সেল পেতে মরিয়া গাজার বিশাল জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় । ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দুকের গুলিতে মারা যান বা ইসরাইলি ট্যাঙ্কের দ্বারা পিষ্ট হয়েছেন । গুরুতর আহত হয়েছেন আরও কয়েক শতাধিক।এটি ছিল একটি ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ – বেসামরিক লোকদের উপর গুলি চালানো। তবে তারও ওপরে ছিল ২ মিলিয়ন বেসামরিক নাগরিককে অনাহারে হত্যা করার প্রচেষ্টা । সাহায্যের জন্য অপেক্ষমাণদের উপর ইসরাইলি হামলা এক দফা ছিল না। এটি বেশ কয়েকবার হয়েছে। যদিও কভারেজের অভাবের কারণে অনেকেই তা জানেন না ।ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর জন্য প্রলুব্ধ করতে সাহায্যের কনভয়গুলিকে ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করার দুরভিসন্ধি সাধারণ মানুষের বোঝার মতো নয়। যে কোনো সাংবাদিকের জন্য এই মর্মান্তিক ঘটনার শিরোনামটি লেখা উচিত ছিল, ‘গাজায় সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরাইল’ । অথবা ‘খাদ্যের সংগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার ভিড়ে গুলি চালিয়েছে ইসরাইল । শতাধিক নিহত ও আহত। ‘ কিন্তু সাংবাদিকদের ফোকাস সেদিকে ছিল না।
‘গাজার খাদ্য সহায়তা-সম্পর্কিত মৃত্যু যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে জটিল করে তোলে’
দ্য গার্ডিয়ানের শিরোনামগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল: ‘বাইডেন বলেছেন গাজার খাদ্য সহায়তা-সম্পর্কিত মৃত্যু যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে জটিল করে তোলে’। ইসরাইল দ্বারা গণহত্যা রহস্যময় ‘খাদ্য সহায়তা-সম্পর্কিত মৃত্যু’ – সংক্রান্ত খবরের নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, গার্ডিয়ানের কাছেও এটি গৌণ হয়ে ওঠে। পাঠকরা শিরোনামটি দেখে ভাবতে শুরু করেন, মূল সমস্যা ইসরাইল দ্বারা নিহত এবং পঙ্গু হওয়া শত শত ফিলিস্তিনি নয় বরং ‘খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত মৃত্যু’। যা ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি পাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে বিবিসির শিরোনামেও চোখে পড়ে – ‘গাজায় ত্রাণবাহী কনভয় ঘিরে বিশৃঙ্খলায় ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু’ আবারও অপরাধীর স্থান থেকে ইসরাইলকে সরিয়ে দেয়া হয়। আসলে, আরও খারাপ, অপরাধের দৃশ্যটিও সরানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল দুর্বল সাহায্য ব্যবস্থাপনা । ওয়াশিংটন পোস্ট বার বার লিখে এসেছে : ‘বিশৃঙ্খল ত্রাণ বিতরণ মারাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছে’। সিএনএন একই লাইন লিখেছে যুদ্ধাপরাধকে ‘বিশৃঙ্খল ঘটনা’ হিসেবে চিত্রিত করেছে ।এমনকি ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা এতটাই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে যে, মিডিয়াও সেই খবর করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। Flour Massacre – এর কয়েকদিন পর, দেইর আল-বালাহতে একটি ত্রাণবাহী ট্রাকে ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে নয়জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, যখন গত সপ্তাহে ২০ জনেরও বেশি ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি ইসরাইলি হেলিকপ্টারের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিল ।
গাজায় গণহত্যা
গাজা-ইসরাইল যুদ্ধে যদি কিছু পদ্ধতিগতভাবে পাওয়া যায়, তা হলো গাজায় একটি অভূতপূর্ব গণহত্যায় পশ্চিমা মিডিয়ার কভারেজের ব্যর্থতা।গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে একটি গণনামূলক বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। তারা যে মৃত্যুর সংখ্যার অনুপাত দেখায় তাতে দেখা যাচ্ছে, গাজায় ইসরাইলের হাতে যত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ইসরাইলিদের হত্যা করেছিল হামাস । গবেষণাপত্রটি ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরাইলি এবং আমেরিকানদের বক্তব্য অনেকগুণ বেশি উদ্ধৃত করেছে এবং যখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কার্যত নীরব থেকেছে। বৃটেনে, মুসলিম কাউন্সিল অফ বৃটেন সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং ৭অক্টোবরের হামলার পর প্রথম মাসে টিভি সম্প্রচারের প্রায় ১ লক্ষ ৭৭,০০০ ক্লিপ বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখা গেছে ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনিদের চেয়ে তিনগুণ বেশি সাধারণ। গ্লাসগো মিডিয়া গ্রুপের অনুরূপ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পশ্চিমা সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে ইসরাইলিদের হত্যার জন্য নিন্দামূলক ভাষা ব্যবহার করেছেন – ‘খুন’, ‘গণহত্যা’, ‘নৃশংস হত্যা’ এবং ‘নির্দয়ভাবে হত্যা’ – কিন্তু কখনই ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনিদের হত্যার ক্ষেত্রে এই ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘নৃশংসতা’ এবং ‘হত্যা’ – এর মতো কিছু চেনা শব্দ। যা ঘটনার গভীরতাকেই প্রকাশ করে না। প্রকৃতপক্ষে, সত্যটি হলো যে, ইসরাইলের মিত্ররা চাইলে অনেক আগেই হত্যা , অনাহার বন্ধ করতে পারতো । কিন্তু গাজার রক্তে আজ রঞ্জিত পশ্চিমা মিডিয়ার হাত।