International

গাজা ট্র্যাজেডির এক মাস: বিশ্ব কি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে?

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এক মাস ধরে ইসরাইলের নৃশংস ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ আর লাশের সারি। গাজাবাসীর ওপর ইসরাইল সেনাবাহিনীর এ ভয়াবহ তাণ্ডব শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

সাদা পতাকা হাতে নিয়ে দখলদার ইসরাইলকে থামানোর জন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধান প্রাণপণ চেষ্টা করছেন না বা গাজাবাসীকে রক্ষায় কোনো দেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে না। বরং আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ দখলদার ইসরাইলকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে সংঘাত আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই এক মাসে গাজা এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। গাজার রাস্তায় রাস্তায় এখন ইসরাইলি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর।

আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির মতো বোমা। গাজায় বোমা হামলা যেন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমা হামলাকেও ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ১৫ হাজার টন ওজনের অ্যাটম বোমা ফেলেছিল। আজও জাপানের এ দুই শহরের মানুষ সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক একই বর্বরতা গাজায়ও চালাচ্ছে ইসরাইল। ৩১ দিনে ইসরাইল ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে গাজায়, যা দুটি পারমাণবিক বোমার সমান। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইউরো মেডিটারিয়ান হিউম্যান রাইটস অবজারভেটরির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ইতিহাসের নির্মম যুদ্ধগুলোকেও হার মানিয়েছে আমেরিকার মদদপুষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলের এ ভয়াল আগ্রাসন। এখন গাজায় সম্ভবত একটি ভবনও আর পুরোপুরি অক্ষত নেই। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, পুরো গাজা এখন শিশুদের গণকবরস্থানে পরিণত হয়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য বেসামরিক মানুষ। সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সংঘাতে মোট যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে গাজায় বেশি শিশু নিহত হয়েছে গত তিন সপ্তাহে।

এছাড়া অসংখ্য শিশু ও যুবক নিখোঁজ রয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক শিশু। ফিলিস্তিনি যুবক ও শিশুদের প্রতি ইসরাইল সেনাদের এ নির্মমতা সব নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা গাজার হাসপাতালগুলোয় বোমা নিক্ষেপ করছে। পরিস্থিতি এতটাই সংকটময় যে, আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো কোনো হাসপাতাল আর অবশিষ্ট নেই। সব হাসপাতাল বোমার আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত পানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ। নেই গজ, ব্যান্ডেজ বা চেতনানাশক ওষুধ।

এমনকি ডাক্তাররা বাধ্য হয়ে অনেক রোগীকে চেতনানাশক ইঞ্জেকশন ছাড়াই সার্জারি করছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিদ্যুৎ, পানিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। আর চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে পিতার সামনে সন্তান, সন্তানের সামনে বোমা হামলায় আহত মা-বাবা ও নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, যা খুবই হৃদয়বিদারক।

বর্তমানে এক মহাসংকটময় পরিস্থিতি পার করছে গাজাবাসী। অবরুদ্ধ গাজায় এখন শুধুই হাহাকার আর চারদিকে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ। এ আর্তনাদ আর গগনবিদারি চিৎকার যেন শোনার কেউ নেই। বিশ্ববাসী ৭৫ বছর ধরে ইসরাইলি সৈন্যদের এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নীরব দর্শক। মনে হয় শুধু অবলোকন করা ছাড়া আর কিছুই তাদের করার নেই!

মাঝেমধ্যে দু-চার বাক্যের একটা বিবৃতি দিয়েই তারা শান্ত থাকছে। গাজাবাসীর ওপর ইসরাইলিদের এ হামলার নিন্দা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ জানিয়েছে বটে, কিন্তু কার্যত কেউ গাজাবাসীর জন্য এগিয়ে আসছে না। শুধু বিবৃতি আর ঘৃণা জানিয়ে আরব দেশসহ বিশ্ববিবেক চুপ থাকছে।

গাজাকে মনে করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। কিন্তু আমার মনে হয়, গাজাবাসী কারাগারের থেকেও বেশি নির্যাতন আর জুলমের শিকার হচ্ছে। কয়েদিরা তাদের মেয়াদ শেষে কারাগার থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু গাজাবাসীর মুক্তি নেই। ইসরাইল বহু বছর ধরে পুরো গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে ঢোকা বা বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। ইসরাইল সম্মত না হলে সেখানে পানি, খাদ্য বা জ্বালানি কিছুই আসে না।

আমরা আমাদের বাবা-মা, শিক্ষক, এলাকার বয়োবৃদ্ধদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের শাসন-শোষণের ইতিহাস বা গল্প শুনেছি। কিন্তু গাজাবাসীর মতো এত নির্মমতার শিকার কেউ হয়নি। গাজাবাসীর ইতিহাস সবচেয়ে বেদনার। শুনেছি দুঃখের পর সুঃখ আসে, কিন্তু গাজাবাসীর দুঃখের পর আরও দুঃখ আসে। জন্মের পর থেকেই ইসরাইলি সৈন্যদের নিক্ষেপিত বোমার বারুদের গন্ধ তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। ইসরাইলি সেনাদের বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয় তাদের।

নির্যাতিত ফিলিস্তিনিরা রক্ত দিয়ে ৭৫ বছর ধরে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করছেন, তা তাদের মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রাম। তারা দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত। এখন তারা নিজের মাতৃভূমিতে নিজেদের অস্তিত্বই হারাতে বসেছেন। প্রতিনিয়ত ইসরাইল বাহিনী দখল করে নিচ্ছে তাদের আবাসভূমি। ইসরাইলের আগ্রাসনে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে, হত্যার শিকার হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানসারখ্যাত ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতনের মাঝে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বাঁচতে হচ্ছে।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জোরপূর্বক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হচ্ছে। বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হাত ঠিক করে ইসরাইলি সৈন্যরা। গাজার চারপাশেই হাজারও ইসরাইলি সেনার চৌপ্রহর সশস্ত্র প্রহরা। ফিলিস্তিনের আকাশটাও যেন আজ খোলা নেই। ইসরাইলের জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা দিয়ে ভরপুর।

অবরুদ্ধ জনপদটির বাতাসও ভরে গেছে রাসায়নিক হামলার মরণ-বিষে। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো দখলদার ইসরাইলের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ এ সংঘাতের মূল খলনায়ক হিসাবে কাজ করছে। তারা এ সংঘাতের সঠিক সমাধানের চেষ্টা না করে বরং ইসরাইলকে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে সংঘাত চলমান রাখছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তদন্তে ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও সম্পত্তি দখল, হত্যা, বেআইনিভাবে আটকে রেখে নির্যাতন, অবরোধ আরোপ, বাধ্যতামূলক স্থানান্তরের হাজারও প্রমাণ উঠে এসেছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আটকে রাখা হয়েছে ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগারে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে এসব তথ্য আছে।

নাৎসিদের থেকেও অধিক ভয়ংকর হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। ফিলিস্তিনিদের ওপর যুগ যুগ ইসরাইলি বাহিনীর এসব নারকীয় তাণ্ডবের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে গোটা বিশ্ব। ফিলিস্তিন জনগণ ৭৫ বছর ধরে মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। জানি না আর কত কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিলে, আর কত প্রাণের বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা মুক্তি পাবে এবং নিজেদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ হবে। এ ইতিহাস বড়ই বেদনার। এ ইতিহাস দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ও রুখে দাঁড়ানোর।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto