Trending

গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলের অর্থনীতিকে কতটা বেকায়দায় ফেলেছে

গাজায় ইসরায়েল যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার এখন পঞ্চম মাস। এই যুদ্ধে এরই মধ্যে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলের নিজের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক কারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ, নতুন বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না।

আল–জাজিরা জানিয়েছে, গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি সরকার প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার সংরক্ষিত সৈন্যকে বেতন দিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের গাজায় মোতায়েন করা হয়েছে। এসব সেনাদের অনেকেই উচ্চ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন, যাঁরা আর্থিক খাত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ওষুধ শিল্প ও কৃষির মতো অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন।

গত নভেম্বরে ব্যাংক অব ইসরায়েল দেশটির অর্থনীতির ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে একটি মোটাদাগের হিসাব দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির ওপর প্রভাবের আর্থিক মূল্য হবে ৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ১৯ হাজার ৮০০ কোটি শেকেল। ২০২৩–২৪ সালের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা আগে হিসাব করা হয়েছিল, যথাক্রমে ২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ২ দশমিক ৮ শতাংশ।

২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে যুদ্ধের সবচেয়ে তীব্র পর্যায় শেষ হলে চলতি বছরে ইসরায়েলের ব্যয় দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয় এমন একটি হিসাব দিয়েছিল। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই বিশেষজ্ঞরা নজর রাখছেন মাঠপর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের হালহকিকত কেমন দাঁড়াচ্ছে।

যে শিল্পটি একনাগাড়ে ভালো করছে, সেটি হলো উচ্চ প্রযুক্তি খাত। অনেক বছর ধরেই এ খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ইসরায়েলের দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ শতাংশ আসে এ খাতে থেকে, আর নিশ্চিত করে মোট কর্মসংস্থানের ১৪ শতাংশ।

ইসরায়েলি স্টার্টআপ জগৎ জমজমাট হতে শুরু করে ১৯৯০-এর দশক থেকে। এরপর দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের পরই আছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি। সব মিলিয়ে ৫০০–এর বেশি বহুজাতিক কোম্পানি ইসরায়েলে ব্যবসা পরিচালনা করে, যাদের মধ্যে রয়েছে গুগল, অ্যাপল, আইবিএম, মেটা, মাইক্রোসফট ও ইনটেল করপোরেশন।

যুদ্ধরত একটি দেশে এসব কোম্পানি বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে কি না, এমন উদ্বেগ থাকলেও আপাতত মনে হচ্ছে, এটাকে বড় কোনো হুমকি মনে করা হচ্ছে না।

সমর্থনের প্রদর্শনী

অক্টোবরের ৭ তারিখের হামলার এক সপ্তাহের মধ্যেই ২২০টির বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান একটি বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েলর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। একই সঙ্গে তারা সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানায় যে তারা যেন ইসরায়েলের প্রযুক্তি খাতকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখে। এসব ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল বেইন ক্যাপিটাল ভেঞ্চারস, এইটভিসি, ভেসেমার ভেঞ্জার পার্টনার্স ও জিজিভি ক্যাপিটাল।

ডিসেম্বরের ১৭ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, প্রযুক্তি কোম্পানি ও বেসরকারি ইকুইটি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা ইসরায়েল টেক মিশন সম্মেলনে যোগ দেন। এ সময় জেরুজালেম ও তেল আবিবে এসব নির্বাহী ও ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে একের পর এক বৈঠক হয়। আদতে এসব বৈঠক ছিল যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলি প্রযুক্তি খাতের প্রতি সমর্থন।

ইসরায়েলে টেক মিশন আয়োজন করেছিলেন মিটআপডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড সিগেল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রন মিয়াসনিক, যিনি বেইন ক্যাপিটাল ভেঞ্চারসে একজন বিনিয়োগকারী। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের স্টার্টআপে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগকারী। এখানকার স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতি সমর্থন জানাতে এই এলাকায় সফর ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমাদের অগ্রাধিকার ছিল।’

ইসরায়েলের বেইত শেমেশভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক ও স্টার্টআপ পরামর্শক হিলেল ফুলড জানান, ডিসেম্বরে মার্কিন চিপ প্রস্ততকারক কোম্পানি ইনটেল দক্ষিণ ইসরায়েলে আড়াই হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে একটি কারখানা তৈরির কথা নিশ্চিত করে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একে ইসরায়েলের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ’ হিসেবে স্বাগত জানান। এই কারখানার জন্য ইসরায়েলি সরকার ৩২০ কোটি ডলার অনুদান দিচ্ছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্লারাভিত্তিক বহুজাতিক সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পালো আল্টো নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকান-ইসরায়েলি উদ্যোক্তা নির যুক। ব্যবসা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে এই কোম্পানির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অক্টোবরে তারা ডিগ সিকিউরিটি অধিগ্রহণ করে ৩০ কোটি ডলারের বিনিময়ে। এরপর তাদের অধিগ্রহণের তালিকায় ছিল টালোন সাইবার সিকিউরিটি, ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে।

তবে জেরুজালেমভিত্তিক তালুব সেন্টার ফর সোশ্যাল পলিসি স্টাডিজের প্রধান গবেষক অর্থনৈতিক নীতিবিষয়ক কর্মসূচির চেয়ার বেনিয়ামিন বেনতাল মনে করেন, পরিস্থিতি আসলে কিছুটা মিশ্র ধরনের। তিনি বলেন, কেউ যখন সংখ্যার দিকে তাকায়, তখন দেখা যায় এটা নিম্নমুখী। কিন্তু কেউ যদি মোট বিনিয়োগের দিকে তাকায়, তখন দেখা যায় পরিস্থিতি স্থিতিশীল। অর্থাৎ যারা থাকছে, তারা বেশি বিনিয়োগ করছে।

বেনিয়ামিন বেনতাল আল–জাজিরাকে আরও বলেন, গাজা ভূখণ্ড ও লেবাননে সামরিক অভিযানে একটি পরিষ্কার ফলাফল এবং জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার বাইরেও একটি সুনির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি থাকতে হবে। এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে কীভাবে তা অর্জন করা যাবে।

ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বাহিনী ও হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা একে অপরের প্রতি মিসাইল ছুড়েছেন। ফলে দুই দিকেই হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

পর্যটনে বিশাল ধাক্কা

ইসরায়েলি অর্থনীতির যে খাতটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি হলো পর্যটন। কোভিডের আগে দেশটির জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ আসত এই খাত থেকে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকেরা ভ্রমণ করা কমিয়ে দিয়েছেন।

ইসরায়েলজুড়ে দেখা গেছে রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট খালি। দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও গাজায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পর তেল আবিবে ফ্লাইট বাতিল করে অনেক উড়োজাহাজ কোম্পানি। একই সময় প্রচুর পর্যটক ইসরায়েলে তাঁদের ভ্রমণ পরিকল্পনাও বাতিল করেন। পরে অবশ্য লুফথানসার মতো কিছু বড় এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট আবার চালু করে।

হামাসের ‘অপারেশন আল–আকসা ফ্লাড’ অভিযানের আগে প্রতি মাসে তিন লাখের বেশি পর্যটক ইসরায়েল ভ্রমণ করতেন। নভেম্বরে এই সংখ্যা ৩৯ হাজারে নেমে আসে বলে খবরে বলা হয়েছে।

হিলেল ফুলড আল–জাজিরাকে বলেন, যুদ্ধ কেবল বিষাদময়ই নয়, এটা একই সঙ্গে ব্যয়বহুলও বটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পর্যটনের ওপর এর প্রভাব একবারে জলজ্যান্ত সত্যি ব্যাপার এবং এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।

নির্মাণ খাতে সংকট

ইসরায়েলি জিডিপির ১৪ শতাংশ আসে নির্মাণ খাত থেকে। যুদ্ধ শুরুর পর এ খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই অক্টোবর থেকে ইসরায়েলজুড়ে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। দেশটির নির্মাণ খাতের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ শ্রমিকই ফিলিস্তিনি। ইসরায়েল তাঁদের কাজের অনুমতি দেওয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখেছে।

ফলে ইসরায়েলের শিল্প ও পশ্চিম তীরের অর্থনীতি উভয়েই ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ইসরায়েলের ভেতর, পশ্চিম তীরের সঠিক কিংবা বেআইনি ইহুদি বসতি এবং পূর্ব জেরুজালেমে কাজ করার জন্য ১ লাখ ১০ হাজার ফিলিস্তিনির অনুমতিপত্র ছিল। বেশির ভাগই কাজ করতেন নির্মাণ খাতে। ইসরায়েলিরা এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেননি, কারণ তাঁদেরকে যুদ্ধে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আর বিদেশি শ্রমিকেরা যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ইসরায়েল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

নভেম্বরে ইসরায়েল বিল্ডারস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশটির নির্মাণশিল্প তার সক্ষমতার ১৫ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে। ১ মাস পর ৮ থেকে ১০ হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিককে পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতিতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। ব্যবসা ও কলকারখানা ‘সরবরাহ সংকটের’ মুখোমুখি হওয়ার পর ইসরায়েলের সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু চাহিদার তুলনায় এই শ্রমিকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সে কারণে ইসরায়েল পরিকল্পনা করছে ৭০ হাজার শ্রমিক বিদেশ থেকে আনতে। মূলত চীন, ভারত, মলদোভা ও শ্রীলঙ্কা থেকে এসব শ্রমিক আনতে চাইছে ইসরায়েল সরকার।

গাজার এই যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ঢেউ তুলেছে। আর সে কারণে তা ইসরায়েলের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইসরায়েল হীরা, গাড়ি, পেট্রলপণ্য, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি আমদানি করে। এসব পণ্য আসে লোহিত সাগরপথে। সেখানে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা কেবল বিশ্ববাণিজ্যকেই সমস্যায় ফেলেছে তাই নয়, তা ইসরায়েলের আমদানিকেও ঝামেলায় ফেলেছে। এশিয়া থেকে ইসরায়েল আমদানি করে এমন অনেক পণ্য আফ্রিকা ঘুরে সে দেশে আসছে, ফলে খরচ বেশি হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ কী

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০ শতাংশের মতো ইসরায়েলি নাগরিক জানিয়েছেন যে তাঁদের পারিবারিক আয় ‘বেশি’ বা ‘খুব বেশি’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি করা এক জরিপে লাতেত নামের একটি প্রতিষ্ঠান দেখেছে যে ৪৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী মনে করে, এ বছরের আরও পরের দিকে কিংবা যুদ্ধে শেষে তাদের জন্য কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

একটি বিষয় পরিষ্কার, যেসব ইসরায়েলি পরিবার ইতিমধ্যে দারিদ্র্যপীড়িত কিংবা ৭ অক্টোবরের আগে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল, তারা এই যুদ্ধের কারণে আরও বেশি অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় পড়বে।

বেইত শেমেশভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক হিলেল ফুলড যেমনটা বলেছেন, রাজনীতিবিদদের মনে কী আছে, তা জানা কঠিন। নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার যুদ্ধ শেষ করতে নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুদ্ধের অর্থনৈতিক বিবেচনা খুব বড় ভূমিকা রাখছে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d