গাজীপুরে গুলিতে গার্মেন্টসশ্রমিক নিহত : মহাসড়ক অবরোধ, পুলিশের গাড়িতে আগুন
গাজীপুরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে সোমবারেও বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সাথে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। সংঘর্ষকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে। তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
নিহতের নাম রাসেল হাওলাদার (২৬)। গাজীপুর মহানগরীর বাসন সড়ক এলাকার এনার্জিপ্যাক ডিজাইন গার্মেন্টসে ইলেকট্রিশিয়ান পদে চাকরি করতেন রাসেল। তিনি ঝালকাঠি জেলার সদর থানার বিনয়কান্দি গ্রামের হান্নান হাওলাদারের ছেলে। সোমবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি)বাসন থানার অফসার ইনচার্জ (ওসি) আবু সিদ্দিক ও স্থানীয়রা জানান, প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন ও বিক্ষোভ করে আসছে। সোমবার সকাল থেকে গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড়, ভোগড়া, নলজানী, ও মালেকেরবাড়ি এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। আন্দোলনরত শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাওজোড়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একদিকে মালেকের বাড়ি অন্যদিকে নলজানি এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় পৌঁছে বিক্ষোভ করতে থাকে। তিন দিক থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক বন্ধ পড়ে এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা পড়ে ভয়াবহ ভোগান্তিতে। ঘটনাস্থল থেকে ঢাকামুখী লেনে দক্ষিণ সালনা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাড়ির জট সৃষ্টি হয়। পরে যাত্রীদের অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হয়।
জানা গেছে, শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতে করতে আশপাশের বিভিন্ন পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ঢিল ছুঁড়ে ভাঙচুর করে। মিল কারখানা ছাড়াও তারা বিভিন্ন বাড়িতেও ঢিল ছুঁড়ে ভাঙচুর করে। এ সময় বাধা দিলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে এবং পুলিশের সাথে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশের ভোগড়া এলাকার কলম্বিয়া পোশাক কারখানার শ্রমিকরা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে স্থানীয়রা ও জয়দেবপুর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নেভায়। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে শ্রমিকরা ভোগড়া মধ্যপাড়াবাজার এলাকার কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। স্থানীয়রা প্রতিরোধ করলে তাদের সাথে সংঘর্ষ বেধে যায় তাদের। শ্রমিকদের লাঠির আঘাতে স্থানীয় গোশত ব্যবসায়ী মো: মমিন মিয়ার মাথা ফেঁটে গেছে বলে জানিয়েছেন তার চাচাত ভাই মো: আনোয়ার হোসেন।
এদিকে শ্রমিকদের একটি গ্রুপ ভোগড়া এলাকায় অবস্থান নিয়ে যানবাহন ও কারখানায় ভাঙচুর করতে গেলে শিল্প পুলিশ ও থানা পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে ওই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়।
নিহত রাসেলের বন্ধু আবু সুফিয়ানসহ আন্দোলনরতরা জানায়, বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে রাসেলের বুকে গুলি লাগে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেয়া হলে রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
আবু সুফিয়ান আরো বলেন, ‘গাজীপুরের মালেকের বাড়ি এলাকার একই ভাড়া বাসায় থেকে একই কারখানায় চাকরি করতাম আমি ও রাসেল হাওলাদার।’
আহত রাসেল হাওলাদারের সাথে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসা টঙ্গী পূর্ব থানার কনস্টেবল তিলক বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাসেলকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ রাসেল হাওলাদারের লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। আমরা বিষয়টি বাসন থানাকে জানিয়েছি।’
অপরদিকে মহানগরীর কোনাবাড়ি এলাকায় বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। পুলিশ টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
গাজীপুর বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সিদ্দিক জানান, শ্রমিকরা সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করেছে। সড়কে বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুর করে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মঈনুল হক জানান, ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ও তেলিচালা এলাকার লেগোস অ্যাপারেলস, এটিএস, বে-ফুটওয়ারসহ বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে। সপ্তম দিনের মতো সোমবারেও শ্রমিকরা আন্দোলন বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করে। তারা উত্তেজিত হয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও ইটপাটকেল ছুঁড়ে। পরে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।