Trending

গাড়ি জমি বাড়ি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধনও বাতিল হতে পারে ঋণখেলাপিদের!

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করছেন না, সেসব ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন না। পাবেন না রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণেও নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে। এসব খেলাপির কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজার কিংবা রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) নিবন্ধও পাবেন না। তাদের নামে থাকা গাড়ি, জমি, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট থাকলেও সেগুলোর নিবন্ধনও বাতিল হতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা জারি করেছে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করে না করলে তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কিংবা যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করলে অথবা অন্য কোনো ব্যাংকের জামানতকৃত সম্পদ অনুমতি ছাড়া নতুন ঋণে জামানত হিসেবে দেখালে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর বাইরে আদালতে মামলা করেও বিপুল পরিমাণের ঋণ আটকে আছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এত দিন ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। দেশের সব শ্রেণির মানুষের দাবির মুখে এবার ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আলাদা ইউনিট গঠন করতে হবে, যার নাম হবে, ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’। আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তার অধীনে এই ইউনিট গঠন করতে হবে। এই ইউনিট ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তা শনাক্ত করবে। শনাক্ত হওয়ার পর শনাক্তকরণের কারণ উল্লেখ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে তার বক্তব্য দেওয়ার জন্য ১৪ কর্মদিবস সময় দেবে। ওই সময়ের মধ্যে বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হলে অথবা তার বক্তব্য যথাযথ বিবেচিত না হলে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিটকে’ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাংকের এমডি ও সিইওর অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। তবে জাতীয় শিল্পনীতিতে বর্ণিত সংজ্ঞানুযায়ী ‘বৃহৎ শিল্প’ খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, ‘মাঝারিশিল্প’ খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতিসম্পন্ন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির বা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন গ্রহণ আবশ্যক হবে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে চূড়ান্তকরণের পর সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। তবে সংক্ষুব্ধ গ্রাহক অবহিত হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কাছে আপিল করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল না করলে এ বিষয়ে ব্যাংকের আগের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। তবে গ্রাহক আপিল করলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে।

এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরকেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। এসব সংস্থা তাদের আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ারও যোগ্য হবেন না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় কারও নাম এলে ঋণ পরিশোধ করে তালিকা থেকে অব্যাহতির পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। আর যদি কোনো পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে পড়েন, তাহলে তার পরিচালক পদ বাতিল হবে। কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার পর তালিকার বিরুদ্ধে আপিল না করলে বা আপিল করার পর তা নামঞ্জুর হলে তাকে দুই মাসের মধ্যে অর্থ পরিশোধের জন্য নোটিস দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ক্রমে খেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে ব্যাংক। এতে সংশ্লিষ্ট ঋণ, অগ্রিম বা পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি ত্রৈমাসিকে ব্যাংকের অডিট কমিটির সভায় উপস্থাপন করতে হবে। অডিট কমিটি উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি পর্যালোচনা করে গুরুত্ব বিবেচনায় এ বিষয়ে তাদের মতামত বা সিদ্ধান্ত পরবর্তী পর্ষদ সভাকে অবহিত করবে। ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত নিয়মিত বা বিশেষ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বিষয়ে পর্যালোচনাসহ একটি আলাদা অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তা নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে টীকা আকারে প্রকাশ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাবের বিপরীতে আরোপিত বা অনারোপিত কোনো সুদ মওকুফ করা যাবে না এবং পুনঃতফসিলও করা যাবে না। ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাবটি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান টেকওভার করতে পারবে না। ওই ঋণ সম্পূর্ণ আদায় বা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবেই বিবেচিত হবেন।

কোনো ব্যাংক এসব নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিবেচিত হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে অন্যূন ৫০ লাখ টাকা এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। যদি নির্দেশনা লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রথম দিনের পর প্রত্যেক দিনের জন্য অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button