গুমের শিকার সুমনের মা: মরার আগে ছেলেকে জীবিত অথবা মৃত দেখতে চাই
‘আমি গুম হওয়ার সুমনের মা। দীর্ঘ বছর হয়ে গেলো ছেলের কোনো খোঁজ পাই না। আপনারা দোয়া কইরেন, মরার আগে যেন আমার ছেলেকে দেখে যেতে পারি।’ গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমার অডিটোরিয়ামে মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তেজগাঁও থানার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন। ওই দিন সুমনসহ আটজনকে তুলে নেওয়া হয়। সুমনের দুই কন্যা সন্তান নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সন্তানহারা এ মা। বাংলাদেশে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের স্মরণে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠন।
অনুষ্ঠানে শুধু সুমনের মা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবারের সদস্যরা এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলেন। এদের মধ্যে এসেছেন কারও সন্তান, স্ত্রী, মা, বোন। সবারই একটাই প্রার্থনা- অন্তত তাদের পরিবারের সদস্যদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
আবদুল কাদের ভূঁইয়া যখন নিখোঁজ হন, তখন তিনি তিতুমীর কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এরপর কেটে গেছে এক দশক। এখনো সন্ধান নেই তার। একমাত্র সন্তান ঘরে ফিরবে, এখনো সেই প্রতীক্ষায় আছেন মা আয়েশা আলী। অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় আয়েশা আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার কণ্ঠ বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে মুখ দিয়ে রক্তও বের হয় তার। তিনি বলেন, ‘সন্তান যদি ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে না আসে, এই যন্ত্রণা নিয়ে একজন মায়ের বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার—সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’ একটি বার সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার জন্য আর কত অপেক্ষা করব।’
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, শেখ হাসিনার লোহার হার্ট আছে। সি ইজ রিয়েলি হার্টলেস। আমি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করেছি, কিন্তু তার হার্ট আছে এমন আমি কখনো দেখিনি। অভিনয় করে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু এই কান্না তার কাছে যায় না। যে নেত্রী বলেন যখন ডিমের দাম কম থাকবে, তখন সেদ্ধ করে তা ফ্রিজে রাখবে। হাউ স্টুপিড। উনি জানেন না এমন কোনো কিছু নেই, শুধুমাত্র মানুষের দুঃখ কষ্ট উনার কাছে পৌঁছে না। উনার বুকের মধ্যে মমতা নাই। যতই কাঁদেন, তার চোখের কোন ভিজবে না। এই সরকার যতদিন পর্যন্ত আছে ততদিন পর্যন্ত গুম হয়ে যাওয়া মানুষের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। আপনারা কষ্ট পেতে পারেন, তবে পাঁচ বছর আগেও এই কথা বলেছিলাম এবং আজও একই কথাই বলছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের হত্যা করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, বাংলাদেশের ব্যাংক লুটপাট করার জন্য, লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার জন্য- এই গুমগুলো করা হয়েছে। ভিন্ন মতের মানুষদের মনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য এইসব করা হয়েছে। যদি আমরা গুমের বিচার চাই, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের বিচার চাই তাহলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশে বাংলাদেশের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গুমের মতো অমানবিক কাজ যাঁরা করেছেন, আজ পর্যন্ত তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তবে দেশে গুমের বিচার না হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একদিন এসবের বিচার হবে। এই বিচার না হওয়ার পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের আন্তর্জাতিকভাবে হলেও একদিন অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশ যে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে এটা ঠেকানোর উপায় এই সরকারের নেই। তারা যতই বলুক তারা অভিজ্ঞ, বর্তমান বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এই সরকার ক্ষমতায় থাকা মানে আরো গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যাওয়া।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার বাসে আগুন দেওয়া, হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া, মাদক ধরিয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের চক্রান্তের জালসহ সবকিছু করবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি নিয়ে আমরা রাজপথে দাঁড়াবো। তাদের সব শক্তিকে আমরা নস্যাৎ করে দেব- সেই শপথ আমাদের নিতে হবে। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। কারণ, ওই ভয় পাওয়ানোটাই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সব সমস্যার সমাধান একজন। তিনি অমরত্ব লাভ করার জন্য আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান। এজন্য বিরোধী দল নির্মূল করার জন্য তার একটা টার্গেট থাকবেই। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তাই বিরোধী দলের যেসব ভাইয়েরা রাজপথে আন্দোলন করছে তাদেরকে এক থাকতে হবে। হয় লড়ো, না হয় মরো।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা কোনো প্রতিশোধের রাজনীতি করি না। কিন্তু যারা খুনি ডাকাত এবং প্রতিটি গুমের সঙ্গে দায়ী তাদের বিচার করা হবে। দেশকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যাবো।
অনুষ্ঠানে ২০১২ সালে নিখোঁজ বরিশালের ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার বলেন, তিন মাসের ব্যবধানে ফিরোজ খান ও তার ভাই মিরাজ খান নিখোঁজ হন। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে তিনি বরিশাল থেকে পিরোজপুরে চলে যান। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সেখানে তিনি সেলাইয়ের কাজ করে মানবেতর জীবন পার করছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি খালেদ হাসানকে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। খালেদ হাসানের স্ত্রী শারমিন সুলতানা বলেন, জানি না সে বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে। আমার পরিচয় এখন গুম সোহেলের স্ত্রী আর আমার সন্তানের পরিচয় গুম সোহেলের ছেলে। আমার একটাই দাবি, আমার স্বামীকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।
‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুমের শিকার পরিবারের স্বজনেরা এসেছিলেন। তাঁদের হাতে ছিল নিখোঁজ প্রিয় মানুষগুলোর ছবি। সবারই আকুতি ছিল প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার ২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে গুম হওয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের ভাই খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমার ভাই কোন অপরাধে ১৩ বছর ধরে গুম হয়ে আছে জানি না। আমি বিচার চাইব না, শুধু ভাইয়ের লাশটা ফেরত চাই। একটাই চাওয়া আমার, ভাইকে যেন নিজ হাতে কবর দিতে পারি, ভাইয়ের লাশ একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি।’
গুমের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুমের সব অভিযোগের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। গুমসংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটিকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, গুমের শিকার আব্দুল বাসেদ মারজান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত সাবেক মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির স্থায়ী কমিটির সদস্য তানিয়া রব, মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি প্রমুখ।