গুম কমিশনে ১০০০ অভিযোগ, অপেক্ষা ঘোচানোর আশায় স্বজন
গুম হওয়ার পর আইনের আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ পাননি অনেকের পরিবার * নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তাও জানেন না অনেক স্বজন
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ব্যক্তি বা তার স্বজনরা গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ করছেন। কমিশনে এক হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সময়ে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় এসব অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ভুক্তভোগী নিজে, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজন এবং গুম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। কেউ সশরীরে গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে আবার কেউ ডাকযোগে অথবা ই- মেইলে অভিযোগ করেন। বেশির ভাগ ঘটনায় অভিযোগের তির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিকে। কখনো প্রকাশ্যে বাহিনীর পোশাক পরে আবার কখনো সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকের আর হদিস মেলেনি। অনেকের স্বজন বছরের পর বছর মামলা লড়ে ক্লান্ত আবার অনেকে আইনের আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ পাননি। নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তাও জানেন না। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর বেশির ভাগই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অবশেষে স্বজন ফেরার অপেক্ষা ঘোচানোর প্রত্যাশায় গুমসংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ করছেন তারা।
গুম হওয়াদের সন্ধানে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ১৫৫ জন এখনো ফিরে আসেননি। এ সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি যুগান্তরকে জানান, না-ফেরাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় ৩০০ ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রাথমকিভাবে জানা গেছে।
এ সংক্রান্ত কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অগণিত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক, যে বাহিনীরই হোক, তাদের ডাকার ক্ষমতা কমিশনের আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীদের কাছে যত অভিযোগ আছে, তা সংগ্রহ করছি। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে-প্রমাণ করা যে এখানে গুম হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে-কে গুম করেছে, তা প্রমাণ করা।’ উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় আন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম ব্যক্তিদের সন্ধানে ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় কমিশন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশনের অন্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা কমিশনের তদন্তের জন্য বিবেচনায় আনা যাবে। ইতোমধ্যে অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভিযোগ দায়েরের সময়সীমা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়। এর আগে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত অভিযোগ জানানোর সময় বেঁধে দিয়েছিল কমিশন। পরে তা বাড়িয়ে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়।
অভিযোগকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে যুগান্তরের। এমন একজনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাসা থেকে র্যাবের পোশাক পরা একদল সশস্ত্র লোক বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে তুলে নিয়ে যায়। নিখোঁজের কিছুক্ষণ পরেই খবর পায় পরিবার। এরপর থেকে র্যাবের অফিস, ঘটনার আশপাশের থানা, ডিবি অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুমনের সন্ধান দিতে পারেননি কেউ। এ ঘটনায় থানা মামলা পর্যন্ত নেয়নি। অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ করেছেন সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি।
সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি (গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গড়ে ওঠা সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়ক) যুগান্তরকে জানান, সুমন ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর র্যাব-১-এর সদস্যরা রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। র্যাবের পোশাক পরা সদস্যরা তাদের গাড়ি ও আর্মসসহ তুলে নিয়ে যায়। দুটি মাইক্রোবাস ছিল তাদের সঙ্গে। চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয় সুমনকে। নির্মাণাধীন যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে, সেখানে বিকালে মিটিং করেছিল সুমন। রাত ৮টার দিকে নিয়ে যায়। এ সময় সুমনের সঙ্গে থাকা আরও পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যায়। তারা বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
তিনি বলেন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী ওই সময়ে বাসায় থাকতে পারতেন না সুমন। যেদিন তুলে নিয়ে যায়, ওইদিন রাত ২টার দিকে আরও দুজনকে তুলে নেয়। তখনও র্যাবের গাড়িতে সুমন ভাইকে দেখা গেছে। মোট আটজনকে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। র্যাবের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করা হয়েছে। এত বছর মামলা করতে পারিনি। ভাটারা থানায় অনেকবার গিয়েছি। মামলা নেয়নি। পরে ২০১৬ সালে হাইকোর্টে রিট করেছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুলও জারি করে কোর্ট।
এছাড়া রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকা থেকে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি অপহরণ হয় ব্যবসায়ী মো. কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী। সাদা পোশাকে একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। এখনো ফিরে আসেননি এ ব্যবসায়ী। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, তাও জানেন না স্বজন। ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন স্ত্রী মোছা. জোসনা বেগম। ১১ বছর মামলা লড়তে কোর্ট-কাচারি ঘুরে ক্লান্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব স্ত্রী জোসনা। শেষ ভরসা হিসাবে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে ২৪ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী কুদ্দুসের মেয়ে ফারজানা আক্তার টুম্পা।
গুমসংক্রান্ত কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা এবং অনুরূপ যে কোনো বাহিনী বা সংস্থার কোনো সদস্য বা সরকারের মদদে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি কর্তৃক আয়নাঘর বা যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত স্থানে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করা; তাদের শনাক্ত করা; কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল, তা নির্ধারণ করা এবং সে উদ্দেশ্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যসহ যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। বলপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা এবং এ বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা। গুম ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবহিত করাও এ কমিশনের কাজ। কমিশন গুম ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবে। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বাংলাদেশের যে কোনো স্থান পরিদর্শন এবং যে কোনো ব্যক্তিকে কমিশনে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।