গুম: তদন্ত কমিশনে ১৬০০ অভিযোগ
গুম সংক্রান্ত কমিশনে ১৬০০ অভিযোগ পড়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। মঙ্গলবার সকালে কমিশনের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই তথ্য জানান। গত ৩১শে অক্টোবর গুম সংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ দেয়ার সময় শেষ হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ৬০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে এবং ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ৮টি গোপন আটক কেন্দ্র খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। তবে তদন্তের স্বার্থে এই আটক কেন্দ্রগুলো কাদের দ্বারা পরিচালিত হতো সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
গুমের সঙ্গে বাহিনীর কতোজন সদস্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কমিশনের সভাপতি বলেন, সেই সংখ্যাটা এখনো বলা যাবে না। ৭ই নভেম্বর থেকে বাহিনীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে। আমরা সমন ইস্যু করে দিয়েছি। প্রথম দিন সাতজনকে ডাকা হয়েছে। তারপর তিনজন, সাতজন, পাঁচজন এভাবে চলতে থাকবে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ডিজিএফআইয়ের সদস্য রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ডিজিএফআই, র?্যাব, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি ও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, পুলিশ আসামিদের কীভাবে অ্যারেস্ট করবে, তার ডিটেলস গাইড লাইন আছে। সেটা কিন্তু ফলো করা হয়নি। আইজিপি দেশের বাইরে আছেন, তিনি দেশে এলে কমিশনে নিয়ে আসবো। একটা সার্কুলার দেয়ার জন্য বলবো। তাহলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে, ভায়োলেন্স হবে না। গুমের সঙ্গে কারা সংশ্লিষ্ট সেসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, আমরা র্যাব পরিচালিত একটি সেল পেয়েছি, যেটি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫ বাই ৪ ফুট। সেখানে আলো ঢোকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। একটি ড্রেন ছাড়া সেখানে কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ছিল না। এমন পরিবেশেই বন্দিদের বছরের পর বছর ধরে সেখানে রাখা হয়। কমিশনের আরেক সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রমাণ নষ্ট করছে। তারা সেল ও দেয়াল ভেঙে ফেলছে। যেসব বাহিনী প্রমাণ নষ্ট করছে তারা আমাদের সহযোগিতা করছে না। এখনকার কর্মকর্তারাও আগের কর্মকর্তাদের অপরাধে জড়িত ছিলেন।
কমিশনের সভাপতি বলেন, আমরা বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করছি। ডিজিএফআই, উত্তরা র্যাব-১, র্যাব সদর দপ্তর, নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১, মোহাম্মদপুরের র্যাব-২, আগারগাঁওয়ে র্যাব-২ এ ক্রাইম প্রিভেনশন সেন্টার পরিদর্শন করেছি। ডিবি কার্যালয়ও এর আগে পরিদর্শন করা হয়েছে।
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যে ৪০০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানে ১৭২টি ঘটনায় র্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ৩৭টিতে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সম্পৃক্ততা ছিল ৫৫টিতে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৬টিতে এবং পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৫টিতে। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট কোনো বাহিনীর পরিচয় না দিয়ে প্রশাসনের লোক বা সাদাপোশাক পরিহিত অবস্থায় থেকে কাউকে তুলে নিয়েছে, এমন ৬৮টি ঘটনা পাওয়া গেছে। অভিযোগ দেয়ার সময় ৩১শে অক্টোবর শেষ হয়েছে। তবে এখনো যদি কেউ যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে অভিযোগ জমা দিতে চান, সেগুলো দেখা হবে বলে জানান কমিশনের সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালার চিত্র বর্ণনা করেন কমিশনের সদস্য নূর খান। তিনি বলেন, একটা মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে, এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর বাইরেও কারও কারও নাম আমরা পেয়ে গেছি। আমরা শুনেছি, আয়নাঘর, যেটা দ্বারা আমরা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারকে বুঝতাম, এর চেয়েও নিকৃষ্টতম সেল আমাদের কাছাকাছি জায়গাতেই ছিল। আমরা সেগুলো পরিদর্শন করেছি। ওই গোপন বন্দিশালাটি র্যাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো বলে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, বন্দিশালাটিতে আমরা দেখেছি, কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে রাখা হয়েছে। এমনও ঘটনা আছে, সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দীর প্রসাব-পায়খানার জায়গা। এর মধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হয়েছে।