Bangladesh

গোপন বন্দিশালায় ৮৮ দিন চোখ বেঁধে নির্যাতন

গোপন বন্দিশালা থেকে শোনা যেত উড়োজাহাজ ওঠানামার শব্দ। মাঝেমধ্যেই ভেসে আসত নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির আর্তনাদ। সেই সময় উচ্চ শব্দে গান বাজানো হতো। কোনো বন্দিশালায় ছিল স্ট্যান্ড ফ্যান, আবার কোনোটিতে ছিল উচ্চ শব্দের ভেন্টিলেশন ফ্যান। কোনো বন্দিশালা থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যেত, কোনোটি থেকে শোনা যেত না। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে যাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছিল, তাদের ছয়জনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাদের সবার বর্ণনায় মোটামুটি মিল রয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়া অন্য পাঁচজন জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় পেটানো হতো। দেওয়া হতো ক্রসফায়ারের হুমকি। তুলে নেওয়ার সময় মাইক্রোবাসে উঠিয়ে চোখ এবং হাত বাঁধা হয়। ছেড়ে দেওয়ার সময় বলা হয়, জীবনে কখনও যেন সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ না খোলে। মুখ খুললে আবার গুম করা হবে। 

ফিরে আসা তিনজন জানিয়েছেন, শৌচাগার ব্যবহারের সময় ছাড়া সারাদিন চোখ বেঁধে রাখা হতো। পাওয়া যেত আজানের ধ্বনি। সেই ধ্বনি শুনে তারা দিনরাত সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন এবং দিন গুনে রাখতেন। অন্য তিনজন জানিয়েছেন, বন্দিশালার ছোট্ট ঘরে থাকার সময় চোখ খোলা রাখা হতো। শৌচাগারে নেওয়ার সময় চোখ বাঁধত। আজানের ধ্বনি শুনতে পেতেন না। এসব বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, একাধিক গোপন বন্দিশালা ছিল আওয়ামী লীগ শাসনামলে। ছয়জনই বলেছেন, তৎকালীন সরকারের আদেশে পুলিশ, র‌্যাব বা অন্য কোনো বাহিনী তাদের গুম করেছিল।

গত ১ জুলাই রাজধানীর আজিমপুরের ছাপরা মসজিদের সামনে থেকে সাদা পোশাকের কয়েক ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায় ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সহসভাপতি আতিকুর রহমান রাসেলকে। চোখ বাঁধার আগে তিনি পুলিশের লালবাগ থানার এবং র‌্যাব-১০ লেখা দুটি গাড়ি দেখতে পেয়েছিলেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনোই রাসেলকে তুলে নেওয়ার কথা স্বীকার করেনি।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাসেলকে রাতে ফেলে যায় রাজধানীর পূর্বাচলে। এর আগে ৩৬ দিন গোপন বন্দিশালায় তাঁর ওপর চলে বর্বর নির্যাতন।
২০১৩ সালের ২৪ জুন রাজধানীর বাড্ডার পিপলস ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিদ্যালয়ের দুই নেতা আজিজুর রহমান এবং মোজ্জামেল আলীকে (ছদ্মনাম) তুলে নিয়ে যায় কয়েক ব্যক্তি। দু’দিন পর রাজধানী থেকে আবদুস সালাম নামে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিবির নেতাকে ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। প্রথম দু’জনকে ৮৮ দিন এবং পরের জনকে ৮৬ দিন গোপন বন্দিশালায় আটকে রেখে ভয়ংকর নির্যাতন চালানো হয়। 

২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে অস্ত্রধারী কয়েক ব্যক্তি রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে। ৬১ দিন পর ভারতে নিয়ে যায় তাঁকে। ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েলকে তুলে নিয়ে ১৮৩ দিন গুম করে রেখে, গোপন বন্দিশালায় নির্যাতন করা হয়। 

নাম জেনে তুলে নেয় গাড়িতে
ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমান সমকালকে জানান, গত ১ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে আজিমপুরের ২৭ নম্বর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাঁচ-ছয়জন এসে নাম-পরিচয় জানতে চান। এর পর তাদের সঙ্গে সামনে যেতে বলেন। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ছাই রঙের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। এর পর শুরু হয় কিলঘুসি। চিৎকার আর কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না যায়, সেজন্য উচ্চ শব্দে গান চলছিল গাড়িতে। 

আতিক জানান, আনুমানিক এক ঘণ্টা চলার পর গাড়ি থামে। তাঁকে নামিয়ে দুই সিঁড়ি পেরিয়ে একটি কক্ষে নেওয়া হয়। সেটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের সময় চলতে থাকে মারধর। সব প্রশ্নের উত্তর দিলেও কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিল। 

আতিক আরও জানান, তাঁর নামে থাকা একটি মামলায় জামিনে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করা ব্যক্তিরা জানতে চাচ্ছিলেন, বিএনপির বড় বড় নেতার মধ্যে কাকে কাকে চেনেন? শাহবাগে কেন যান? নির্যাতনের পর নেওয়া হয় একটি ছোট ঘরে। আনুমানিক পাঁচ হাত দৈর্ঘ্য এবং তিন হাত প্রস্থের ঘরটির উঁচু দেয়ালে ভেন্টিলেশন ফ্যান উচ্চ শব্দে চলত ২৪ ঘণ্টা। কক্ষটিতে কারাগারের মতো লোহার গ্রিল এবং এর পর ছিল কাঠের দরজা। দরজার ওপরের দিকে ছিদ্র করা ছিল। দরজা সব সময় বন্ধ থাকত। বাইরে যারা দায়িত্বে থাকতেন, কারও চেহারা দেখা যেত না। বন্দিশালায় নেওয়ার আগে দুটি লুঙ্গি, দুটি গেঞ্জি ও একটি জায়নামাজ দেওয়া হয়।

বাথরুম-ওয়াশরুমে নেওয়ার সময় হ্যান্ডকাফ ও চোখ বাঁধলেও ভেতরে নেওয়ার পর খুলে দেওয়া হতো। এক মাসের বেশি সময় কোনো আজানের শব্দ শুনতে পাননি তিনি। প্রথম ছয় দিন লোহার গ্রিলের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা হয়। গ্রিলে হাত ঝুলিয়ে মারধর করত। প্রতিবার নির্যাতনের আগে প্রেশার মাপা হতো। টানা তিন দিন ঘুমাতে দেওয়া দেয়নি। কক্ষের দেয়ালে ভিন্ন ব্যক্তির হাতে লেখা ছিল। কেউ স্বজনের কাছে খবর দিতে আকুতি জানিয়ে ফোন নম্বর লিখেছেন। লেখা ছিল ‘ইন ২০১৪ আউট ২০২০’। আরেকটি হাতের খেলা ছিল ‘ইন ২০১৬ আউট ২০২১’।

আতিক বলেন, ৫ আগস্ট রাতে চার-পাঁচজন মুখ ঢেকে ঘরে এসে দ্রুত তৈরি হতে হুকুম করে। বলে, ‘আজ তোকে নতুন পৃথিবীতে নেব। তুই শুধু খুশি হবি।’ এর পর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এবং চোখ বেঁধে গাড়িতে ওঠানো হয়। এক-দেড় ঘণ্টা পর নির্জন একটি স্থানে নামিয়ে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। ১০ মিনিট পর চোখের বাঁধন খুলতে বলা হয়।

ফজরের আজান শুনে চোখ খুলে আতিক মূল সড়কে এসে বুঝতে পারেন, তাঁকে পূর্বাচলে ফেলে গেছে। ভাড়া করা মোটরসাইকেলে কুড়িল বিশ্বরোড আসার পর বাবাকে ফোন করেন। তখন জানতে পারেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আতিকের বাবা ছেলের সন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। কিন্তু কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই আতিককে তুলে নেওয়ার কথা স্বীকার করেনি।

চোখ বাঁধা অবস্থায় ৮৮ দিন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দুই নেতা আজিজুর রহমান এবং মোজ্জামেল আলীকে (ছদ্মনাম) একই গোপন বন্দিশালার একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল। ৮৮ দিন তাদের চোখ ও হাত বাঁধা ছিল।

আজিজুর সমকালকে বলেছেন, রাজধানীর বাড্ডা থেকে ধরে গাড়িতে তুলে কয়েকজন সুঠাম দেহের ব্যক্তি। সাদা মাইক্রোবাসে তুলে চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। আনুমানিক ৪০ মিনিট চলার পর গাড়িটি ইউটার্ন নিয়ে কয়েক মিনিট চলার পর থামে। এর পর কাঁধে করে ওপরে তোলা হয়। এ কারণে বুঝতে পারেননি কয়তলায় তোলা হয়েছে। একটি কক্ষে নিয়ে বসতে দেওয়া হয়। আধা ঘণ্টা পর শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। বসিয়ে রাখার সময় তিনি মোজাম্মেল আলীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন। সে সময়ে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছিল। এর পর আজিজুরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। একজন প্রশ্ন করতে থাকে, আরেকজন পেটাতে থাকে। শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোথায় আছেন, জানতে চাওয়া হয়। জবাব দেওয়ার পরও পেটানো চলতে থাকে। আজিজুর রহমান বলেন, এক পর্যায়ে ঝুলিয়ে কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পেটানো হয়। তবে পাঁচ-ছয়টি আঘাতের পর মারধর টের পাননি। 

মোজাম্মেল আলী বলেন, শিবির বিদেশ থেকে এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা পায় কিনা, জানতে চাচ্ছিল জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। নেতিবাচক জবাব দেওয়ার পর মাথায় ড্রিল মেশিন ধরা হয়। ড্রিল করে মাথা ফুটো করে মগজ বের করে আনার হুমকি দেয়– পেটাতে থাকা জিজ্ঞাসাবাদকারীরা।

আজিজুর জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে কী করা হবে? একজন জবাব দেন, ‘থাক, আল্লাহ ভরসা। ভাগ্য ভালো হলে মা-বাবার কাছে যেতে পারবা। নইলে কী হবে, বুঝতেই পারছ।’

আজিজুর জানালেন, তারা শবেবরাতের দিন গুম হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর চোখ বাঁধা এবং হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থায় একটি কক্ষে নেওয়া হয়। বাইরে চার বেলায় পাহারাদার বদল হতো। যারা পাহারায় থাকতেন, তারা কক্ষে আসতেন। একজন সদয় ছিলেন। তিনি ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন, সান্ত্বনা দিতেন।

আজিজুর এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সহবন্দি দু’জনই জানান, শুধু খাবার দেওয়ার সময় এবং শৌচাগার ব্যবহারের সময় হাতের বাঁধন খুলে দিত। সব সময় হাত পেছন দিকে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় থাকায় কখনও শুয়ে ঘুমাতে পারতেন না। খাবার ভালোই দিত। ৮৮ দিনের মধ্যে দু’দিন পোলাও-মাংস খেতে দিয়েছে। রোজার সময় দু-একটি কলা, আপেল দিয়েছে। ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে দাড়ি-গোঁফ ছেঁটে দেওয়ার সময় আয়নায় একজনের মুখ দেখেন।

আজিজুর সমকালকে বলেন, ‘আমার অনুমান কর্মকর্তা পর্যায়ের একজন সেই দিন মাগরিবের পর এসে বলছিলেন, ছেড়ে দেওয়ার পর কী কী করতে হবে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, কখনোই সাংবাদিকদের সামনে মুখ না খোলাসহ ১০-১২টি উপদেশ দেন।’ আজিজুর জানান, গাড়ি ঘণ্টাখানেক চলার পর তাঁকে চোখ খুলে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে বসে থাকতে বলে। ১০ মিনিট পর চোখ খুলতে বলে। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর আজিজুর চোখ খুলে দেখেন জঙ্গলে ফেলে গেছে তাঁকে। ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর মূল সড়কে উঠে জানতে পারেন, জায়গাটি ময়মনসিংহের ভালুকার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি। 

এই দুই শিবির নেতার পরিবার দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সন্ধান চেয়েছিল। তবে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটকের কথা স্বীকার করেনি।

৬১ দিনের বন্দিজীবন
২০১৫ সালের ১০ মার্চ বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হওয়ার বিষয়টি ছিল দেশজুড়ে আলোচিত। তাঁকে ৬১ দিন বন্দি রাখার পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়। সেটি ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের হতে পারে। কক্ষের এক কোণে ছিল শৌচকর্মের ব্যবস্থা। লোহার দরজার নিচ দিয়ে খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হতো। কক্ষের বাইরে একটি স্ট্যান্ড ফ্যান চালু থাকত। ছাদে ছিল উচ্চ আলোর বাতি। ৬১ দিনের মধ্যে একবারও ঘর থেকে বের করেনি। সবই করা করা হয়েছে তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের হুকুমে। এসব কাজের জন্য কোথাও না কোথাও তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
বন্দি অবস্থা থেকে ভারতে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেদিন ঘর থেকে বের করে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়িতে আনুমানিক ছয়-সাত ঘণ্টা ঘোরানো হয়। সেখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করল তারা। এর পর কিছুদূর হাঁটিয়ে আবার কিছুদূর গাড়িতে করে নেওয়া হয়। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি মাঠের কোণে তাঁকে ফেলে যায়। তখনও সূর্য ওঠেনি। প্রাতভ্রমণকারীদের কাছে জানতে পারেন জায়গাটি ভারতের মেঘালয়ে শিলংয়ের গলফ লিংক এলাকা। তাঁর পরিচয় জানানোর পর প্রাতভ্রমণকারীরা পুলিশে খবর দেন। সেখানে আইনি জটিলতা কাটিয়ে দীর্ঘ ৯ বছর পর গত ১১ আগস্ট দেশে ফেরেন তিনি। গত বছর তাঁর মামলা শেষ হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অসহযোগিতার কারণে তিনি দেশে ফিরতে পারছিলেন না।

১৯৪ দিন পর গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার 
ছাত্রদল নেতা মেহেদী হাসান রুয়েল জানান, ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় সাদা পোশাকের পাঁচজন তাঁর নাম জানতে চায়। নাম বলার পর রুপালি রঙের একটি মাইক্রোবাসে তুলে হাত এবং চোখ বেঁধে ফেলে। শুরুতে বুঝতে পারেননি কোথায় নেওয়া হয়েছে। মারধরের পর তাঁর জবানবন্দি ভিডিও করতে শৌচাগারে নেওয়া হয় মুখ ধোয়াতে। সেখান থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে পুলিশের এপিবিএন ব্যাটালিয়নের মাঠ দেখতে পান। এ থেকে বুঝতে পারেন র‌্যাব-১ কার্যালয়ে আনা হয়েছে। 

২০১৪ সালে র‌্যাব-১-এর কার্যালয় ছিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে। রুয়েল জানান, গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয় এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। বিএনপির বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিতে বলা হয়। সেই সময় চোখ বাঁধা ছিল। শুরুতে কাগজে সই নেয়, পরে জবানবন্দির ভিডিও করে। তবে তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের চেহারা দেখতে পাননি। সবার মুখ মুখোশে ঢাকা থাকত।

রুয়েল বলেন, র‌্যাব-১ কার্যালয়ে সাড়ে চার মাস বন্দি থাকা অবস্থায় হ্যান্ডকাফ এবং চোখের বাঁধন খোলা হয়নি। শুধু শৌচাগার ব্যবহার এবং গোসলের সময় খুলে দেওয়া হতো। একজন প্রহরী ধরে ধরে শৌচাগার পর্যন্ত নিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিত। সেই শৌচাগারে জানালা ছিল না। 

রুয়েল জানান, ডেমরার ছাত্রদল নেতা শাওন ও রাজুকেও আনা হয়। একদিন ছয়টি সিঁড়ি পেরিয়ে গাড়িতে তেলা হয়। এতে বুঝতে পারেন, মাটির নিচে কোনো কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের তিনজনকে চোখ এবং হাত বাঁধা অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে ঘোরানো হয়। পরে জানতে পারেন, বরিশাল র‌্যাব কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তুলনামূলক ভালো ছিলেন। দেয়ালে রক্ত দিয়ে গুমের তারিখ, পরিচয় লেখা ছিল বন্দিশালায়। তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ঝন্টু রক্ত দিয়ে নিজের পরিচয় এবং তাঁর ভাইয়ের ফোন নম্বর লিখে গিয়েছিলেন। লেখা ছিল, ‘যদি কেউ এখান থেকে বের হতে পারেন তাহলে যেন তাঁর ভাইকে এই নম্বরে ফোন দেন।’ ঝন্টুর খোঁজ আজও মেলেনি। 
রুয়েল জানান, অসুস্থ হয়ে পড়ায় গুমের ৬ মাস ১৪ দিন পর তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন রাতেই বরিশাল কোতোয়ালি থানা পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায়। ২৮ দিন পর জামিনে মুক্তি পান। 

এখনও অনেকে নিখোঁজ
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। গুম হয়েছেন ৬৭৭ জন।

গুম হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে পরবর্তী সময়ে। তাদের বড় অংশকেই পরে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। তবে আদালতে তুলে দাবি করা হয়, আগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, জোরপূর্বক তুলে নেওয়া ৮৬ জন ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী, আইনজীবী মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান, মাইকেল চাকমা ফিরেছেন গোপন বন্দিশালা থেকে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৫ বছর ৩ মাস থেকে ৮ বছর ৪ মাস গুম ছিলেন। 

জার্মান-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার গোপন বন্দিশালায় রাখা হতো। যেগুলো ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। 

আলোচিত গুমের ঘটনার মধ্যে বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক, দলটির সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হীরুসহ অন্তত ২৫ নেতা এখনও নিখোঁজ। জামায়াত এবং শিবিরের অন্তত ৯ জনকে তুলে নেওয়ার পর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অনেকের সন্ধান নেই। 
তাদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছে স্বজনের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। তারা ডিজিএফআই কার্যালয়, র‌্যাব কার্যালয় এবং পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। 

সরকারের উচিত তদন্ত করা 
গুমের শিকার চারজনের ভাষ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায়, তারা র‌্যাব-১ কার্যালয়ের বন্দিশালায় ছিলেন। তারা সবাই বিমান ওঠানামার শব্দ এবং আজানের ধ্বনি শুনতে পাওয়ার কথা বলেছেন। র‌্যাব-১ কার্যালয়ের ঠিক পেছনেই একটি মসজিদ আছে। সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার দূরে বিমানবন্দরের রানওয়ে। তবে এই বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ মুনিম ফেরদৌস সমকালকে বলেছেন, ‘এমন কোনো সুযোগ নেই। আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যেসব ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে দায়িত্বে ছিলাম না।’

ভুক্তভোগীদের বর্ণনা শুনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল সমকালকে বলেছেন, গোপন বন্দিশালায় মাসের পর মাস আটকে রাখার বিষয়টি আর অভিযোগের পর্যায়ে নেই। নিশ্চয়তা, সত্যতা রয়েছে। সরকারের উচিত, তদন্ত করা। নিশ্চিত হলে, দায়ীদের আইনের আওতায় এনে ভুক্তভোগীদের প্রতিকার দিতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
bacan4d
bacan4d