গ্যাসের পর এবার কয়লার সংকট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত
গ্যাস সংকটের মধ্যেই আর্থিক, আইনি ও কারিগরি সমস্যার কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। পুরোপুরি বন্ধও হয়ে গেছে দুটি। ফলে সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণও বেড়েছে।
বর্তমানে দেশের সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তিন হাজার ১৯৯ মেগাওয়াটের মতো, যদিও এদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার ৯৯ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুতের উৎস ভারতের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড লিমিটেড বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে প্রায় ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আদায়ের অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ অক্টোবর থেকে কয়লার অভাবে পুরোপুরি বন্ধ আছে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে অবস্থিত এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অর্ধেক সক্ষমতায় উৎপাদনে ছিল।
কর্মকর্তারা বলেছেন, ডিসেম্বরের আগে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন পুনরায় চালু করা সম্ভব নয়।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট) মো. আদনান ইব্রাহিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কয়লা আমদানি করার প্রক্রিয়া চলছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কয়লা এলে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।’
তিনি বলেন, তার কোম্পানি প্রায় ৩৫ লাখ টন কয়লা সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালাতে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টন কয়লার দরকার হয়।
আদনান ইব্রাহিম জানান, কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বিষয়ে আইনি জটিলতা দেখা দেওয়ায় কয়লা কিনতে দেরি হচ্ছে।
এদিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর দীর্ঘদিন ধরেই কয়লার সংকট যাচ্ছে রামপাল আর এসএস পাওয়ারের। অর্ধেকেরও কম সক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি চলছে।
পিডিবির একটি সূত্র জানায়, মূলত ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেশীয় কয়লা ব্যবহার হলেও তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুটি উৎপাদনে আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৪৪৪ মেগাওয়াট হলেও দুটি ইউনিট থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে ২৩৫ মেগাওয়াটের মতো।
সবচেয়ে বড় ২৭৫ মেগাওয়াটের ইউনিটটি উৎপাদন করতে পারছে ১৭০ মেগাওয়াট করে।
একমাত্র পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র তার সক্ষমতার পুরোপুরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে বরিশাল বিভাগ ছাড়া অন্য সবকটি বিভাগেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে পিডিবি।
পিডিবি বর্তমানে দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১১ হাজার মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৩ হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট করে কম।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৮৬ মেগাওয়াট।
জুনের শুরু থেকে দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মধ্যে একটি প্রযুক্তিগত সমস্যায় পড়লে গ্যাসের ঘাটতি দেখা দেয়, যা ছিল পিডিবির জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়।
এফএসআরইউ দুটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ স্বাভাবিক সময়ে এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দিনে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছিল।
কিন্তু গত মাসজুড়ে এই এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এই সরবরাহ করা গ্যাস দিয়ে ১২ হাজার ৬৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট।
পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়লেও এখন কয়লার সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কয়লা আমদানি আমাদের পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু সেটা আমি আজকে চাইলে কালকেই আনতে পারছি না। কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের আমদানি করতে হয়। এখন সেসব প্রক্রিয়া চলছে।’
দিনাজপুরের হিলিতে পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতা রবিউল ইসলাম জানান, গত কয়েকদিন ধরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে তার আমদানি করা পেঁয়াজের অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘গুদামের ভেতরে বাতাস ঠাণ্ডা রাখতে অনবরত ফ্যান চালাতে হয়। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে সব সময় ফ্যান চালানো সম্ভব হয়নি। গরমে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে।’
রবিউল জানান, দিনের বেলায় প্রতি তিন থেকে চার ঘণ্টা পর পর প্রায় এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়।
ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ এলাকার চালকল মালিক আব্দুল হান্নান জানান, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে তার মিলের উৎপাদন অনেক কমে গেছে।
তিনি জানান, তার মিলে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়।