Trending

গ্যাস সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে শিল্পকারখানা

আগামী মাসের মাঝামাঝির আগে এ সংকট কাটছে না -পেট্রোবাংলা * সামিটের একটি এলএনজি টার্মিনাল ১ মাস ধরে অচল * গ্যাসের চাপ প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই দরকার হলেও আছে মাত্র ১-২ পিএসআই!

তীব্র গ্যাস সংকটে ধস নেমেছে শিল্পকারখানার উৎপাদনে। মুখ থুবড়ে পড়েছে শত শত কারখানা। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। শিল্পমালিকরা বলছেন, সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে না পারায় বাতিল হচ্ছে ক্রয়াদেশ। পণ্য না পেয়ে বিদেশি বায়াররা চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। সংশ্লিষ্টদের মতে একটি কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ দরকার হলেও সে চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে এক থেকে দুই পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এভাবে চলতে থাকলে অনেক শিল্পকারখানা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় মালিকরা। শ্রমিকদের বেতন নিয়েও চলছে দুশ্চিন্তা।

জানা গেছে, গত ২ মাস ধরে গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল কোনাবাড়ী, মৌচাক সফিপুর ও চন্দ্রা এলাকা প্রায় গ্যাস শূন্য। সম্প্রতি ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে ডেমরা, মদনগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গাজীপুর শিল্প এলাকায় পাঁচ হাজারের বেশি কলকারখানা রয়েছে। বেশিরভাগ কারখানা গ্যাস নির্ভর। আর এ খাতে কাজ করছেন ২২ লাখ শ্রমিক। গত ১ মাস ধরে এ এলাকার শিল্পমালিকদের চোখে ঘুম নেই। এ অবস্থায় তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাদের দাবি, রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে হবে।

শিল্পমালিকেরা বলছেন, একদিকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) মিলছে না, অন্যদিকে গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে এ খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণের অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে চিঠিও দিয়েছে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার অবশ্য বলছেন, এলএনজি টার্মিনালের সংস্কার শেষে দ্রুতই কেটে যাবে গ্যাস সংকট। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় একটি এলএনজি টার্মিনাল বর্তমানে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। টার্মিনালটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। তিনি আশা করছেন, আগামী মাসের মাঝামাঝি এ সংকট কমে আসবে।

শিল্পমালিকরা বলেছেন, শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকট নতুন নয়। তবে বেশ কিছুদিন ধরে এ সংকট তীব্র হয়ে পড়েছে কারখানাগুলোতে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমনিতেই রপ্তানি আদেশ কম, এরপরও যে রপ্তানি আদেশ আমাদের আছে সেটাও আমরা সময়মতো করতে পারছি না। আমরা এখন আমেরিকার মার্কেটে ১৯ পার্সেন্ট মাইনাস পজিশনে রয়েছি, যেখানে ভিয়েতনাম এবং চায়না পজিটিভ গ্রোথ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।’

রোববার সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী নেতা একে আজাদ বলেছেন, গ্যাস সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অনেক শিল্পকারখানা বসে গেছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকায় দেশে বিনিয়োগ আসছে না উল্লেখ করে একে আজাদ আরও বলেন, প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে ক্যাপিটেল মেশিনারিজ আমদানি। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ। বাজেটের অধিকাংশ ব্যয় অনুন্নয়ন খাতে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে দামি গাড়ি কেনা হচ্ছে-যেখানে ভারতের মন্ত্রীরা নিজেদের দেশের গাড়িতে চড়েন। ভারতের বিনিয়োগ পলিসির কথা তুলে ধরে একে আজাদ বলেন, তাদের জমি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সাবসিডাইজ, ৫ বছরের জন্য কর্মীদের বেতন দেয় সরকার, বিনিয়োগ তো সে দেশেই হবে। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ না হলে কর্মসংস্থান হবে না।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘টেক্সটাইল, স্পিনিং এবং ডাইং এগুলো তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা চলে। গ্যাস সংকটের কারণে এ খাতে কোথাও কোথাও ৫০ শতাংশ আবার কোথাও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসে উৎপাদন।’

হিসাব বলছে, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী ১ হাজার ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি মেটানো হয় এলএনজি দিয়ে। তবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্পকারখানায় গ্যাস-সংকট বেড়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘সামনের মাসের জন্য আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা শুরু করেছি। একটা কেনা হয়ে গেছে। এটি সেটিং করে আরও একটা কিনে ফেলব। সামনে সব স্বাভাবিক থাকবে।’

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে তীব্র গ্যাস সংকট : শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের বেশিরভাগ এলাকায় গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। কয়েক মাস ধরে লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে অধিকাংশ কারখানার চাকা বন্ধ হওয়ার পথে।

গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল কোনাবাড়ী, মৌচাক সফিপুর ও চন্দ্রা এলাকার সুতা তৈরির কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পে গ্যাস সংকটে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যেটি প্রভাব ফেলবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

এই এলাকার কারখানার মালিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও অনেক কারখানায় সেই গ্যাসের চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে ২ থেকে ৩ পিএসআইতে বিরাজ করছে।

এই অবস্থায় সময়মতো কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে না পারায় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন শিল্পকারখানার মালিকরা। তাদের শঙ্কা এখন যথাসময়ে উৎপাদন না হওয়ায় রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়া নিয়ে। কালিয়াকৈর উপজেলার খাড়া জোড়া নামক এলাকার এসএ স্পিনিং মিলসে গত ১ মাস ধরে গ্যাস সংকটের কারণে সুতা তৈরির মেশিন চালাতে পারছে না। ফলে অর্ধেকের বেশি মেশিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তার এ সুতা তৈরির করাখানায় ৪০টি মেশিন থাকলেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় ৫-৬টি মেশিন চালাতে হচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন নেই বললেই চলে। গ্যাস সংকট থাকায় এই সুতা তৈরির কারখানায় দুটি জেনারেটর বন্ধ রয়েছে। ফলে মেশিন বন্ধ রেখে শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে গ্যাস কোম্পানিদের একাধিক অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা পাওয়া যাচ্ছে না বলে এ কারখানার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন।

কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর যমুনা স্পিনিং ডিভিশনের একজন জিএম (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) বলেন, দিনভর কারখানায় গ্যাস থাকে না। কারখানার চার শিফটের মধ্যে এক শিফট কাজ চলে; বাকি তিন শিফট কাজ করানো যাচ্ছে না। কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আনা যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতে কষ্ট হবে। কালিয়াকৈর পূর্বচান্দরা বোর্ড মিল এলাকার একাধিক কারখানা মালিক জানান, বেশিরভাগ সময়ই গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তার কারখানায় গ্যাসের চাপ প্রয়োজন হয় ৬ পিএসআই আমরা ১ পিএসআই পাচ্ছি না। কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ ২-৩ পিএসআই বেশি উঠে না। বাধ্য হয়ে ডিজেলের জেনারেটর চালাতে হয়। এভাবে ডিজেল ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তখন লোকসান গুনতে হবে।

এসএ স্পিনিং মিলস লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ মাস ধরে গ্যাস সংকটে এই স্পিনিং মিল বন্ধের উপক্রম হয়ে যাচ্ছে। যেখানে ৪০টি সুতা তৈরির মেশিন চালাতে ১০ পিএস গ্যাস লাগে; সেখানে প্রতিদিন গ্যাসের চাপ পাচ্ছি ১ থেকে দেড় পিএসআই। ফলে অর্ধেকের বেশি মেশিন বন্ধ রেখে শ্রমিক কারখানায় বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এ কারণে প্রতি মাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গাজীপুর জোনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুরে যে পরিমাণে গ্যাসের চাহিদা সেই পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যায় না। যার কারণে কিছু কিছু এলাকায় গ্যাসের সংকট রয়েছে। এছাড়া অনেক এলাকায় আবাসিকের সংযোগে পাইপগুলো পুরাতন হয়ে যাওয়ায় বাসাবাড়িতেও গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। সেগুলো ধীরে ধীরে সমাধান করা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button