গ্যাস সঙ্কট : পরিবারের খাবারের যোগান দিতে ঘুম হারাম হাজারো গৃহিণীর
‘খাবার রান্না করা তো দূরের কথা, বাচ্চাদের পানিটাও ফুটিয়ে নিরাপদ করে খেতে দিতে পারছি না কদিন ধরে।’
চট্টগ্রাম শহরের হাজার হাজার মানুষের দিনযাপনের গল্পটা ফিরিঙ্গি বাজারের বাসিন্দা ননী ঘোষের মতোই। নিয়মিত গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবারের যোগান দিতেই ঘুম হারাম হচ্ছে তার মতো হাজারো গৃহিণীর।
‘চুলায় কিছুটা গ্যাস পাওয়া যায় রাত ৩টা-৪টার দিকে। গত কয়েক মাস ধরে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ওই অল্প গ্যাসে কোনোরকমে সকালের নাস্তা তৈরি করি। গত দু’দিন ধরে সেই সামান্য গ্যাসও আসছে না।’
কয়েক মাস ধরে বাড়িতে নিয়মিত গ্যাস না পাওয়া যাওয়ায় কিছুদিন আগে কেরোসিনের চুলা কিনেছেন ননী ঘোষ। কিন্তু কোরোসিনের চুলা খরচসাপেক্ষ হওয়ায় সবসময় সেটি ব্যবহার করেন না তিনি।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের এই বেহাল পরিস্থিতির শুরু হয় গত নভেম্বর থেকে। সেসময় থেকেই শহরের অনেক বাসিন্দা খাবার রান্নার জন্য ঘরে কেরোসিন বা লাকড়ির চুলা এনে রেখেছেন। ঘরে গ্যাস সিলিন্ডারও কিনে রেখেছেন অনেকে।
নভেম্বর থেকে গ্যাস সংকট চললেও দিনের কোনো না কোনো সময় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল। তবে গত দু’দিন একেবারেই বন্ধ ছিল গ্যাস সরবরাহ। যার ফলে রেস্টুরেন্টে আর খাবারের দোকানে ভিড় করতে দেখা গেছে মানুষকে। কিন্তু দোকানে খাবারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় দোকানগুলোও সবাইকে খাবার দিতে পারছে না।
গ্যাস সংকটে চট্টগ্রামের মানুষের যে শুধু খাবার জোগাড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তা নয়। বাসাবাড়ির পাশাপাশি গ্যাস পাম্পেও গ্যাস ছিল না গত দু’দিন ধরে। যার প্রভাব পড়েছে নগরের যাত্রী পরিবহন সেবাতেও। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বহু গাড়িকে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত গ্যাস পাম্পের বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
গ্যাস পাম্পগুলোর গল্পটাও বাসাবাড়ির মতোই। বৃহস্পতিবার রাত থেকে গ্যাস সরবরাহ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলেও গ্যাসের নিয়মিত সরবরাহ না থাকা বা পর্যাপ্ত চাপ না থাকার মতো বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে পাম্পগুলো চলছে নভেম্বর মাস থেকেই।
টাইগার পাস এলাকার ইন্ট্রাকো ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার আবদুর রহমান বলছিলেন- দু’দিন ধরে তাদের পাম্প বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় নভেম্বর মাস থেকেই সীমিত পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়েছে তাদের।
‘গত দুই মাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে না বললেই চলে, যার ফলে যানবাহনে গ্যাস দেয়া সম্ভব হয় না। তারপর নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস দেয়া বন্ধ রাখতে হয়। রাত ১১টার পর কিছুটা ব্যবসা করতে পারি আমরা।’
তিনি বলেন, গত দুই মাস ধরে লোকসান দিয়েই ব্যবসা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরকম পরিস্থিতি আরো কিছুদিন চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আবদুর রহমান।
গ্যাস স্টেশনগুলোর মতো কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে গ্যাসনির্ভর অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানেও। কারণ দেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামেও গার্মেন্টস, সার কারখানা, স্টিল মিলসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন গ্যাসের নিয়মিত ওপর নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় এসব কারখানায় নিয়মিত কার্যক্রম উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, গ্যাসের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকা শিল্প খাতকে বহুমুখী ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
‘নভেম্বর থেকে গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। বড় ধরনের ফ্যাক্টরিগুলোর মেশিনগুলো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানিতে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। সেই পরিমাণ জ্বালানি না পাওয়া গেলে উৎপাদন তো কমেই, মেশিনেও ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়।’
আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গার্মেন্টসের মতো রফতানি পণ্য তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না হলে তারা বিদেশী ক্রেতাদের কাছে সময়মতো অর্ডার সাপ্লাই করতে পারে না। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার ক্রেতারাও অনেক সময় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’
এরকম পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে কর্মী ছাঁটাই করা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে পথ থাকবে না, বলেন মাহফুজুল হক শাহ।
পূর্বাঞ্চলে গ্যাসের এই পরিস্থিতি যে কারণে
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার ঘনফুটের বেশি। আর দৈনিক সরবরাহ করা হয় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
এর মধ্যে ৯০০ থেকে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসতো মহেশখালির দু’টি ভাসমান টার্মিনাল থেকে, যেগুলো আমদানিকৃত এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) প্রক্রিয়াজাত করে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করতো। ২০১৮ সালে এই দুটি টার্মিনাল কার্যকর হয়।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই টার্মিনাল দু’টির একটি নভেম্বরে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সে কারণে নভেম্বর মাস থেকে চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহে সংকট দেখা দেয়।
আর বুধবার মহেশখালিতে অবস্থিত দ্বিতীয় টার্মিনাল থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়লে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়।
তবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষে সিঙ্গাপুর থেকে একটি টার্মিনাল এরই মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে আর মহেশখালির দ্বিতীয় টার্মিনালটিও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানা গেছে।
কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
এরকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে গ্যাসের এই সংকট কতদিন চলবে? আর সংকট নিরসনে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান যে আগামী দুই বছরে গ্যাস আহরণ বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার।
‘২০২৫ সালের মধ্যে আমরা অন্তত ১০০টি গ্যাসের কূপ খনন করবো। দুই বছরের মধ্যে আমরা অন্তত আরো ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়মিত সরবরাহ করতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।’
তবে যোগান বাড়লেও গ্যাসের বাড়তি চাহিদা থেকেই যাবে, বলেন নসরুল হামিদ। তার হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
পাশাপাশি, নসরুল হামিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে খুব শিগগিরই গ্যাস সংকটের সমাধান হবে না।
‘মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে পরিস্থিতি যদি বড় আকার ধারণ করে, তাহলে বাংলাদেশে জ্বালানির মূল্যের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। তবে আমরা মনে করছি অন্তত এই বছরে গ্যাস আমদানিতে আমাদের সমস্যা হবে না।’