গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কোন পথে?
বিবদমান প্রতিহিংসাপরায়ণ এই সমাজে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব।
পূর্ব-পাকিস্তানের গণমানুষ দলমত নির্বিশেষে ভাত ও ভোটের অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ফলে স্বাধিকার আন্দোলন বেগ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যাদের নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছিল তাদের দ্বারাই লুণ্ঠিত হওয়ার সূচনা হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার তারাই পদদলিত করেছিল। পরিস্থিতি এমনই আকার ধারণ করে যে, মনে হচ্ছিল স্বাধীনতার সুফল যেন শাসক দলের জন্যই নির্ধারিত ছিল।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, ’৭৫-এর পট পরিবর্তন, পরবর্তীতে বহুদলীয় রাজনীতি চালু সব ছাপিয়ে যখন গণ মানুষের ভোটাধিকার বাস্তবায়ন হয় নাই, তখনই পুনরায় শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের আন্দোলন, যার অগ্রভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেই আন্দোলনে অভূতপূর্ব সমাবেশ দেখা গেল বাম দল এবং আমিরে জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের। সেনা সমর্থিত ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে ২০০৮ সাল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে নির্বাচনের পূর্বেই শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীনে মহাজোট সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনপদ্ধতি সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দেয়ার কারণেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালে একতরফা নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়, স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেস্তে দেয়ার দায় পড়ে শেখ হাসিনার কাঁধে। সে কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন এবং কূটনীতিকরা সরকারকে বিভিন্ন প্রশ্নবাণে প্রশ্নবিদ্দ করছেন, আমেরিকা প্রণয়ন করছেন ভিসানীতি যা এর আগে কখনো ঘটেনি। শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অর্থাৎ জাতীয় কোনো ইস্যু মঞ্জুর বা নামঞ্জুর, গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান সর্ব ক্ষেত্রেই সরকার সংবিধানের রেফারেন্স সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছে।
সংবিধানে ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকারিতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে, সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদে ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ এর মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয়েছে। ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ বলতে নির্বাচনে অর্থাৎ প্রার্থী নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে রয়েছে কি? অন্যদিকে বিরোধী দল কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম সঠিক ও যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারছে? আন্তর্জাতিক চাপে যা এখন সরকারকে মেনে নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামী, তবে এখানে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী লোকের অভাব নেই, বরং সংখ্যাধিক্য। ফলে তাঁবেদারি তোষামোদি সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে এবং যারা এসব বিষয়ে অপারগ তারা ছিটকে পড়ছে। আর যারা তাঁবেদারি ও তোষামোদিতে সিদ্ধহস্ত সমাজে তাদের পোয়াবার। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে অবস্থানে চলে গেছে সেখানে মেরুদণ্ড সোজা রেখে দায়িত্ব পালন করা দুষ্কর! ফলে সংখ্যায় কম হলেও রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে যারাই মেরুদণ্ড সোজা রেখে সোজাসাপটা সরল পথে চলতে চায় তারাই ছিটকে পড়ছে, নতুবা সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্য আপসকামিতা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করে বা অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে চায় তখন আশপাশের লোকজনের কোনো সমর্থন পায় না।
কারণ আপসকামিতা চরম আকার ধারণ করায় বিবেকের মৃত্যু এখন দৃশ্যমান। কর্তার জয়ে জয়ধ্বনি দেয়ার সংস্কৃতি এখন তুঙ্গে। ফলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মচারীরা ‘ক্ষমতাকে’ পূজা করার কারণে ‘জি হুকুম, জাঁহাপনা’ অর্থাৎ ‘ইয়েস বস’ সংস্কৃতি সর্ব ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। অন্য দিকে, এ দেশের কিছু মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। হাতের মুঠোয় পেলে ভাগ্যহত মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করে আনন্দ ভোগ করার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বিড়াল যেমন ইঁদুরকে খেলতে খেলতে হত্যা করার আনন্দ উপভোগ করে তেমনি ভাগ্যবানরা ভাগ্যহতদের অহেতুক অত্যাচার নির্যাতন করাকে চরমভাবে উপভোগ করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের অনেকেই ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছে যেনতেনভাবে। এমতাবস্থায় ঔপনিবেশিক আদলে গড়ে ওঠা আমলাদের পক্ষে একটি প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি আস্থায় আনা যায় না, এ দেশের নির্বাচনিক পূর্ব ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়।
বিবদমান প্রতিহিংসাপরায়ণ এই সমাজে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব। চলমান পদ্ধতিতে তুমুল সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত শাসক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জনগণের মতামত মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে না। কারণ এখানে চলছে, ‘মুখ মে শেখ ফরিদ, বোগলমে ইট’ সংস্কৃতি। উপরে থাকে সবাই ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট।
প্রকৃতপক্ষে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য সব স্টেকহোল্ডারকে সঠিক, প্রভাবমুক্ত ও বিবেকসম্পন্ন ভূমিকা থাকা আবশ্যক। স্টেকহোল্ডার নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্র ২. সরকার অর্থাৎ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের দ্বারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন (সূত্র : সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২০) ৩. বিচার বিভাগ ৪. নির্বাচন কমিশন। ৫. রাজনৈতিক দল তথা দলের নমিনেশন পদ্ধতি। ৬. ভোটার।
একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্র, সরকার, সরকারি কর্মচারীদের সদিচ্ছার পাশাপাশি বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের সচেতনাসহ সদিচ্ছার দৃঢ়তা থাকা আবশ্যক।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও জনবান্ধব প্রার্থী নমিনেশন দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা আবশ্যক। মিডিয়ার ভাষায় দলীয় ফান্ড গঠনের আদলে বড় দলে ‘নমিনেশন বাণিজ্য’ একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। দল ও জাতির প্রতি অবদান কতটুকু তা বিবেচনার চেয়ে কে কত সম্পদশালী নমিনেশন দেয়ার ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় আনা হয়। ফলে ব্যাংক লুটেরা, মানিলন্ডারিং হোতারা, বিদেশে সাহেবপাড়া, বেগমপাড়ায় বিভিন্ন অট্টালিকার মালিকেরা নমিনেশনপ্রাপ্তির শীর্ষে থাকে, ছিটকে পড়েছে দলীয় নিবেদিত নেতাকর্মীরা, যার মধ্যে নরসিংদী নিবাসী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্যদিকে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার যে, দলীয় নেতাকর্মীরাও টাকা ছাড়া নড়ে না।
নির্বাচনে দাঁড়ালে বোঝা যায় যে, দলের কর্মী তো নয় বরং তারা কর্মচারী। কর্মী চলে আদর্শে, কিন্তু কর্মচারী চলে বেতনে। এতে কর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা যায় না। কারণ প্রার্থী নির্বাচনী বৈতরণী পার হলে, সে নির্বাচিত হয়েই দুই হাতে টাকা কামায়, বাদ পড়ে যায় কর্মীরা, পাশে জোটে আত্মীয়স্বজন ও চামচা বাহিনী। বড় বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার চর্চা করে, কিন্তু আদর্শিক কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয় না। ফলে নমিনেশন, প্রার্থী ও দলীয় কর্মীর আত্মিক সম্পর্কটি এখন টাকা পয়সাকেন্দ্রিক। নির্বাচনে ‘ভোটারগণ’ সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। কিন্তু আমাদের দেশের ভোটাররা সচেতন হলেও অসচেতনতার অভাব নেই। কিছু ভোটার মার্কাভিত্তিক, কিছু ভোটার টাকা-পয়সাভিত্তিক। নিজের বিবেক দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রবণতা আমাদের সমাজে অত্যন্ত কম। ক্ষমতা, পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির কাছে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আমাদের রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা, জবাবদিহিতা এখন আর কেউ আমলে নেয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ভোটারদেরও জবাবদিহিতা থাকা দরকার।
বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই, পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ব রাজনীতি সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক শক্তিধর রাষ্ট্র প্রতিনিয়তই বিবৃতি দিয়ে আসছে, কিন্তু তা কতটুকু আমলযোগ্য হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। অন্য দিকে, লেভেল প্লেইং ফিল্ড অর্থাৎ খেলার সমতল মাঠ এমনিতে বিপর্যস্ত। কারণ আইনি বেড়াজালে আটকে দেয়া হয়েছে প্রধান দুই নেত্রীর মধ্যে এক নেত্রীকে, রাজনীতিবিমুখ করে রাখা হয়েছে, করা হয়েছে তাকে কারাবন্দী যা এখন ৮ বছর অতিক্রম হতে চলল। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন গোটা বাংলাদেশ। রাজনীতির মাঠে একজন মুক্ত, অন্যজন বন্দী। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত লেভেল প্লেইং ফিল্ড প্রত্যাশা করা যায় না।
পূর্ব ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার অর্থই হবে একতরফা নির্বাচনের বৈধতা দেয়া। দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। কোনো সমঝোতায় বিরোধী দল যদি নির্বাচনে যায় তবে ভবিষ্যতে জনগণ তাদের আর বিশ্বাস করবে কি? শুধু তত্ত্বাবধায়কের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের হাত হবে আরো দায়িত্বশীল, সচেতন ও বিবেকের ধারক বাহক।