ঘূর্ণিঝড় রেমালে কতটা ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ল বাংলাদেশ?
সুন্দরবনে স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় দুই বার জোয়ার এবং দুই বার ভাঁটা হয়। সেই হিসেবে ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর গত ৪৮ ঘণ্টায় সুন্দরবন চারবার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত ও চারবার ভাঁটায় পানি নেমে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এবার সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য প্রথম এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, কারণ রেমাল আঘাত হানার পর এবার টানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে তলিয়ে ছিল পুরো বনাঞ্চল।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা এখনই অবশ্য এত সহজ নয়। কারণ জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও গাছপালার যে ক্ষতি হয় তা নিরূপণ করা সময়সাপেক্ষ।
তবে এই মুহূর্তে অবকাঠামোগত যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করা হয়েছে।
এছাড়া রেমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পৌনে দুই লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্যের যে অবস্থা
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল ৩৮ ঘণ্টারও বেশি সময়। এত দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানি থাকায় বন্য প্রাণীদের ক্ষতি হয়েছে।
মারা গেছে ৪০টি হরিণ এবং ১টি বন্য শুকর। সাগরের নোনা পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বন্য প্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠা পানির পুকুরসহ শতাধিক জলাশয়। জীবিত উদ্ধারের পর ১৭টি হরিণকে অবমুক্ত করা হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা জানান, এই এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ গোলপাতার বাগান প্লাবিত হয়ে গেছে।
১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। একটি পল্টুন ভেসে গেছে। এতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এই পশ্চিম বিভাগে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসা ৮টি হরিণকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে দু’টি হরিণ মারা গেছে। বাকি ছয়টিকে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
খুলনার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তবে ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অঙ্কে হিসাব করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা। একই সাথে যে পরিমাণ ভূমি ক্ষয় হয়েছে তাও এখনোই বোঝা যাবে না বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন,‘বনের গাছে শত শত পাখির বাসা ছিল, ডিম-বাচ্চা ছিল। এখন গাছে কোনো পাখি নেই। হরিণ মারা গেছে, গাছ নষ্ট হয়েছে, টাকা দিয়ে এসব মাপা যায় না। সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে।’
এছাড়া বঙ্গোপসাগরের পাশে মান্দারবাড়িয়া এবং হলদিবুনিয়া নামে দু’টি অভয়ারণ্য রয়েছে, যেগুলি পশ্চিম অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এসব অভয়ারণ্যের বন্য প্রাণীদের জন্য তৈরি করা মিঠা পানির পুকুর ভেসে গেছে, জেটি ভেঙ্গে গেছে।
তবে, এখনও সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি বলে জানান কর্মকর্তারা।
দক্ষিণ অভয়ারণ্যের আওতায় হীরন পয়েন্ট বা নীল কমল। এখানে বাঘের কিল্লা নামে ১২টি স্থান রয়েছে। যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে প্রচুর হরিণ আশ্রয় নিয়েছিল। বাঘের কিল্লা হচ্ছে উঁচু স্থান যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য বন্য প্রাণীরা আশ্রয় নেয়।
স্বাভাবিক সময়ে সুন্দরবনে ২৪ ঘণ্টায় দু’বার ভাঁটা আসে এবং তা দু’বার জোয়ারে প্লাবিত হয়। অর্থাৎ ছয় ঘণ্টা পর পর জোয়ার ভাঁটা হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের দুই দিনে ৪৮ ঘণ্টায় চারবার জোয়ার, চারবার ভাঁটা হওয়ার কথা থাকলেও কোনো ভাঁটা হয়নি।
হোসেন বলেন,‘এবারই প্রথম প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পুরো বন তলিয়ে ছিল। এর আগে সিডর বা আইলাতেও এরকম দেখিনি। দীর্ঘ সময় পানি আটকে থাকায় বন্য প্রাণীর বেশি বেগ পেতে হয়েছে। এমন সমস্যা এবারই প্রথম দেখলাম।’
তিনি বলেন, ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টাতেও পানি নামছে না সুন্দরবন থেকে। এবার জোয়ারের পানির উচ্চতাও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বেশি।’
এছাড়া মিঠা পানির পুকুরগুলো লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীর উপর স্থায়ী প্রভাব পড়বে। কারণ পুকুরের মিষ্টি পানি বন্যপ্রাণীর তৃষ্ণা মেটাত।
বাঘ, হরিণ থেকে শুরু করে মৌমাছিও মিষ্টি পানি পছন্দ করে। সুন্দরবনে এখন মধুর সিজন চলছে। মিষ্টি পানি ছাড়া মধু আহরণ করতে পারে না মৌমাছি।
হোসেন বলেন,‘ফলে প্রত্যেকটি বন্য প্রাণীই আগামী কিছুদিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামনে বর্ষার মৌসুম আসছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে পুকুরগুলি ডিওয়াটারিং করে সেখানে বর্ষার মিষ্টি পানি ধরতে হবে। মিষ্টি পানি না ধরা পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে যত দ্রুত বর্ষা মৌসুম আসবে বন্য প্রাণীর জন্য তত ভালো হবে।’
এদিকে সুন্দরবনের পশ্চিম এলাকায় গরান বন বেশি হওয়ার কারণে বন্য প্রাণীর মৃত্যু সংখ্যা কম। কারণ গরান গাছগুলো ঝোপের মত গাছ। ফলে প্রবল তোড়ে গরান বনে পানি ঢুকতে পারে না। তাই সেখানে বন্য প্রাণীর মৃতের সংখ্যা কম। তবে ওখানে লবনাক্ততা বেশি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের এলাকায় কেওড়া বন বেশি। এ গাছগুলো অনেক বড় বড় হয়। ফলে নিচে ফাঁকা থাকায় প্রবল গতিতে পানি প্রবেশ করে বন্য প্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়েছে।
গাছের উচ্চতার তারতম্যের কারণে এই বিভাগে হরিণের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা জানান, কটকা, কচিখালী, দুবলা ও হিরণ পয়েন্ট সৈকতে মৃত হরিণ বেশি দেখা গেছে।
করমজল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির। তিনি বলেন,‘সুন্দরবনে জোয়ারে যে পানি হয় তার চেয়ে এবার পাঁচ-ছয় ফুট বেশি পানি হয়েছে। জোয়ারের পানি ছিল দীর্ঘ সময়। এটা প্রাণীদের জন্য খুবই নাজুক অবস্থা তৈরি করে। কেন্দ্রের কোনো প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে, দু’টি বন্য হরিণ ও একটি শুকরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।’
উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ঘূর্ণিঝড় রেমালে উপকূলীয় এলাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করেছে। উপকূলীয় ১৯টি জেলা রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত দেয়া এ হিসাবে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর ১৯টি জেলার ১১৯টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় রেমাল তার যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির সরকারি যে হিসাব দেয়া হচ্ছে, তাতে।
উপকূলীয় এসব উপজেলার ৯৩৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
রেমালের দুই দিনের তাণ্ডবে পৌনে দুই লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি বাড়িঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি।
খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্লাবিত হয়ে গেছে চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের পোনার খামার। এর ফলে শুধু খুলনা বিভাগেই প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানকার বিভাগীয় কার্যালয়।
আর বাগেরহাটের চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘের পানিতে ভেসে গেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র চাষিরা।
সংবাদদাতা ঘটনাস্থলে কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন মৎস্যজীবীর সাথে। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা বলছেন, পানিতে ঘের প্লাবিত হওয়ায় ভেসে গেছে সব মাছ। ফলে তাদের পুঁজির সব টাকাই নষ্ট হয়েছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা।
ঝড়ের কারণে বিপর্যয় এড়াতে অনেক এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার ঝড় আঘাত হানার পর বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল উপকূলীয় জেলাগুলোর ৩ কোটি তিন লাখ মানুষ।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামত করে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ৮০ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা গেছে। এরই মধ্যে বুধবার বিকেল নাগাদ প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে, পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন,‘পটুয়াখালী ও বরগুনার ১২টি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের মোট ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক। দুপুর পর্যন্ত ৪ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনা গেছে। বাকিদেরও দ্রুত সংযোগ দিতে কাজ চলছে।’
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য সাড়ে ৭ কোটি টাকা।
আবার বাড়তে পারে তাপমাত্রা
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গত কয়েকদিন সারা দেশে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে তাপমাত্রা আবারো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
অধিদফতর যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপটি পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে।
এটি দুর্বল হয়ে আসাম ও তার সংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপ আকারে অবস্থান করছে। একই সাথে গুরুত্বহীনও হয়ে পড়েছে।
পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, বুধবার থেকে যে তাপমাত্রা বাড়ছে তা অপরিবর্তিত থাকবে পরবর্তী দুই দিন।
বৃহস্পতিবার রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়া-সহ বৃষ্টি বা বজ্র-বৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানে অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, এর পরবর্তী পাঁচদিন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে।
এছাড়া সমুদ্র বন্দরসমূহ, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে সংকেত নামিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে।