চড়া সুদে ধার করে লেনদেন, ব্যাংকে তারল্য সংকট
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ঋণ আদায়ে ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কাক্সিক্ষত আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। ফলে চড়া সুদে ধার করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে। গতকালও ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আন্তব্যাংক থেকে তারল্য ধার করেছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়ায় বৈধপথে বাড়ছে না প্রবাসী আয়। আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৫৯০ কোটি ডলার বিক্রি করে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ টাকা কমছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কমেছে ব্যাংকে সঞ্চয়ের প্রবণতা। গত নভেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে; যার প্রভাবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন আমানতকারীরা।
এ ছাড়া ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ী। সবকিছু মিলে ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে দৈনন্দিন লেনদেন ও কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আন্তব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের হাতে জমানোর মতো টাকা নেই। আর সাম্প্রতিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে আস্থাহীনতায় আমানতকারীরা টাকা তুলে হাতে রাখছেন। পাশাপাশি সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ায় ব্যাংকগুলোয় আমানত সংগ্রহে প্রতিযোগিতার কারণেও আমানতে টান পড়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, নীতিনির্ধারণ যদি মনমর্জিমতো হয় তাহলে তো এমন হবেই। ব্যাংক খাতের ভেতরের সমস্যা যেগুলো আছে, সেটা আগে ঠিক করতে হবে। হোটেলে বসে যদি পলিসি রেট ঠিক করা হয়, তাহলে আর কী আশা করা যায়? সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে গার্ডস দেখাতে হবে। না দেখালে প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। ঋণের অপব্যবহার হচ্ছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়ছে না। ডলারের দর বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে না।
সব মিলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব থেকে দেখা গেছে, গতকাল আন্তব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ৫ হাজার ২২৮ কোটি টাকা ধার করেছে। কলমানিতে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে এক দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। ৯ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে চার দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ১৭০ কোটি টাকা। ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে ছয় দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সুদে সাত দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ১৯৫ কোটি টাকা। ১০ শতাংশ সুদে ১১ দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা। ১১ শতাংশ সুদে ১৪ দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ২৩০ কোটি ও ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ২১ দিন মেয়াদি ধারের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা। মঙ্গলবার আন্তব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ধার করেছে ৪ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। তার আগের দিন সোমবার আন্তব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করে চলছে। সোমবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে গেছে। উল্টো ব্যাংকে জমানো টাকা ভেঙে খাচ্ছে অনেকে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের মতো উৎসবের সময় মানুষের নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে। এর বাইরে ৯-৬ সুদহার তুলে দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তব্যাংক তারল্য সংকট বেড়েছে।’ জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বিল, বন্ডের মতো বিভিন্ন উপকরণ বন্ধক রাখতে হয়। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো যেহেতু সুদভিত্তিক বিল ও বন্ড কিনতে পারে না, সে কারণে এসব ব্যাংকের হাতে ধার নেওয়ার মতো উপকরণ থাকে কম। সংকটে পড়া পাঁচ ব্যাংকের জন্য যেটুকু ছিল, তা বেশ আগেই শেষ হয়েছে। ফলে এখন বিশেষ উপায়ে ধার পাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা ফারাক আছে। এ ছাড়া নতুন টাকা ছেপে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটানোর পর আবার সেই টাকা তুলে নিচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য। এ কারণে মুদ্রাবাজারে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে আন্তব্যাংক কলমানি রেট বাড়ছে। এ ছাড়া নির্বাচনকেন্দ্রিক এক ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ নগদ টাকা হাতে ধরে রাখতে চায়। সেটারও একটা প্রভাব আছে মুদ্রাবাজারে।’