Science & Tech

চন্দ্রশেখর লিমিট ও সুব্রহ্মাণ্যন চন্দ্রশেখর

ছেলেটির বয়স তখন সবেমাত্র ২০ বছর। এ বয়সেই পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি শেষ করেছেন। ছাত্র হিসেবে তিনি খুবই ভালো। বাড়ি হলো মাদ্রাজে।

এখন যাকে সবাই চেন্নাই বলে চেনে। ছেলেটি একটি স্কলারশিপ পেয়েছেন কেমব্রিজে পিএইচডি করার জন্য। পছন্দের বিষয় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান। এ বিষয়ে নিয়ে তার রয়েছে প্রচণ্ড আগ্রহ।

তার জন্ম হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। চাচা চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী। আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণের ওপর গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার আবিষ্কার ‘রামন এফেক্ট’ বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত।

ভাতিজার নামও চন্দ্রশেখর। পুরো নাম সুব্রহ্মাণ্যন চন্দ্রশেখর। চাচার মতোই তুখোড় মেধাবী।

সময়টা ১৯৩০ সাল। সে বছর চাচা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

আর ভাতিজা পড়তে যাচ্ছেন কেমব্রিজে। তখনকার যুগে ইংল্যান্ডে যেতে হতো জাহাজে করে। ২০ বছর বয়সী চন্দ্রশেখর মাদ্রাজ থেকে জাহাজে উঠলেন। অনেক দূরের পথ। প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। চন্দ্রশেখর সময়টি অপচয় করলেন না। কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন একটি সমস্যার সমাধান করতে। সমস্যাটির বিষয়বস্তু ছিল নক্ষত্রের জীবনচক্র নিয়ে। এ নিয়ে চন্দ্রশেখর অনেক দিন ধরেই ভাবনা-চিন্তা করছেন। এখন সময় পেয়েছেন এ নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গবেষণা করার। এ বিষয়ে অনেক পড়াশোনা চন্দ্রশেখর ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। তার ইচ্ছে হলো, এ নিয়ে কেমব্রিজে গবেষণা করার।

তখন বিজ্ঞানী মহলে নক্ষত্রের জীবনচক্র নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা জানতে চান একটি নক্ষত্রের জন্ম এবং মৃত্যু হয় কিভাবে। এসব গবেষণার পুরোভাগে ছিলেন কেমব্রিজের একজন অধ্যাপক যার, নাম হলো স্যার আর্থার এডিংটন। সেই সময় স্যার এডিংটন ছিলেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একজন দিকপাল। তিনি মনে করতেন সকল নক্ষত্রের জন্ম এবং মৃত্যু একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়। প্রক্রিয়াটা হলো এ রকম: হাইড্রোজেন গ্যাস মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পুঞ্জীভূত হতে হতে নক্ষত্রের কেন্দ্রে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে থার্মো নিউক্লিয়ার ফিউশন (Fusion) প্রক্রিয়া শুরু হয়। হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তির উদ্ভব হয় এবং নক্ষত্রটি তখন প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। এভাবেই একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। এরপর নক্ষত্রটি জ্বলতে থাকে দীর্ঘদিন। কিন্তু একসময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে থাকে। হিলিয়াম পরমাণুও আস্তে আস্তে আরো ভারী পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। ধীরে ধীরে নক্ষত্রের কেন্দ্রে আয়রনের মতো ভারী পরমাণুর সৃষ্টি হয়। এ সময় নক্ষত্রটির আয়তন অনেক বৃদ্ধি পায়। এটি একটি বিশাল লোহিত দানব (Red Giant) নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্রটি তখনো প্রজ্বলিত থাকে। কিন্তু এর উত্তাপ কমে যায়। তারপর আস্তে আস্তে নক্ষত্রটির হাইড্রোজেন জ্বালানি আরো ফুরিয়ে যায়। তখন সেটা সংকুচিত হতে হতে একটা শ্বেত বামন (White Dwarf) নক্ষত্রে পরিণত হয়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে একটি নক্ষত্রের জীবনাবসান হয়।

তখনকার দিনে এটিই ছিল নক্ষত্রের জীবনচক্রের সর্বস্বীকৃত মডেল। স্যার আর্থার এডিংটন ছিলেন এর প্রবক্তা। কিন্তু তরুণ চন্দ্রশেখরের জিজ্ঞাসু মনে তখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি জানতেন নক্ষত্রের ভেতরে ইলেকট্রনের চাপ (electron degeneracy pressure) এবং নক্ষত্রের নিজস্ব মহাকর্ষ বল (gravitational force) এ দুয়ের মাঝে একটি ভারসাম্য রয়েছে। এই ভারসাম্য থাকার ফলেই নক্ষত্রটি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ধ্বংস (collapse) হয়ে যায় না। কিন্তু তার মনে হলো, এই ভারসাম্যটি নির্ভর করে নক্ষত্রটির ভরের ওপর। তিনি তখন জাহাজে বসেই বেশ কিছু জটিল সমীকরণ সমাধান করে নক্ষত্রের এই ভর সীমাটি নির্ণয় করলেন। তিনি অঙ্ক কষে বের করলেন, শ্বেত বামন নক্ষত্রের সর্বোচ্চ ভরসীমা হলো সৌর ভরের ১.৪৪ গুণ। তার মানে হলো, কোনো শ্বেত বামন নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের চেয়ে ১.৪৪ গুণ বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে সেটি আর শ্বেত বামন নক্ষত্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। নক্ষত্রটি তখন সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হবে।
কেমব্রিজে পৌঁছনোর পর তিনি এই নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন প্রফেসর ফাউলারের অধীনে। এ নিয়ে ১৯৩১ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হওয়ার পর তিনি প্রফেসর স্যার আর্থার এডিংটনের রোষানলে পড়লেন। এডিংটন ছিলেন খুবই প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তিনি কোনোভাবেই তরুণ চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফলাফল মেনে নিতে পারলেন না। চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রচণ্ড সমালোচনা করতে থাকলেন। এতে চন্দ্রশেখর মনে খুব আঘাত পেলেও মুখে কিছুই বললেন না। তিনি মুখ বুজে তার পিএইচডির কাজ শেষ করলেন। পিএইচডির পরও কয়েক বছর তিনি কেমব্রিজে ছিলেন। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। এরপর তিনি সারা জীবন আমেরিকাতেই ছিলেন।

আর্থার এডিংটনের চরম বিরোধিতার কারণে চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফলাফল মেনে নিতে কেমব্রিজের বিজ্ঞানী মহল ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। সে জন্যই মূলত তিনি কেমব্রিজ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে চন্দ্রশেখরই সঠিক ছিলেন। এডিংটন ছিলেন ভুল।

তার আবিষ্কার এখন সারা পৃথিবীতে ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ (Chandrasekhar limit) হিসেবে পরিচিত। যেসব শ্বেত বামন নক্ষত্রের ভর চন্দ্রশেখর সীমার চেয়ে বেশি তাদের অকালমৃত্যু হয় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে। আর এই বিস্ফোরণের ফলে নক্ষত্রটি একটি ব্ল্যাকহোল অথবা নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য চন্দ্রশেখরকে ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু এই পুরস্কারটির জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অর্ধশতাব্দীর চেয়েও বেশি সময়। পুরস্কারের চেয়েও বড় কথা হলো তার আবিষ্কারটি এখন একটি সর্বজনীন বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। অনেকের ধারণা এডিংটন তখন বিরোধিতা না করলে এই স্বীকৃতিটি তার অনেক আগেই প্রাপ্য ছিল। বিজ্ঞানী হিসেবে চন্দ্রশেখর তার সীমা অতিক্রম না করলেও, দুঃখজনকভাবে স্যার আর্থার এডিংটন সেটা করেছিলেন।

১৯৯৫ সালে সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ৮৫ বছর বয়সে লোকান্তরিত হয়েছেন। ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাসা মহাকাশে তাদের স্থাপিত উচ্চ প্রযুক্তির এক্সরে অবজারভেটরির নাম দিয়েছে Chandra X-ray Observatory (CXO)। এর কাজ হলো মহাকাশে ব্ল্যাকহোল, কোয়াসার, সুপারনোভা ইত্যাদি বিভিন্ন উচ্চশক্তির এক্সরে উৎসের সন্ধান করা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d