Hot

চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা: শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিল চাইবে পুলিশ

কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। পাশাপাশি পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই দেশে ফিরেছে। প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের তৎপরতায় রাজধানীতে এক আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক কিছু কর্মী। তারা সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে জমি, মার্কেট, দোকান দখল করছে। এর সঙ্গে আছে গণঅভ্যুত্থানের মুখে কারাগার থেকে পালানো বন্দির মধ্যে অধোরা ৭০০ আসামি। পুলিশের কাছ থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে দেড় হাজার অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোও সন্ত্রাসীদের কাছে চলে গেছে বলে ধারণা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে সেটা স্বীকার করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। গতকাল রবিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ছিনতাই-চাঁদাবাজির যে ঘটনা ঘটছে তা অস্বীকার করছি না। যারা জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে তারাও এ ধরনের কাজ করছে, এটা সত্যি কথা। যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে তাদের আবার তাড়াতাড়ি ধরে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা চেষ্টা করছি, যতভাবেই হোক ছিনতাই-চাঁদাবাজি কমিয়ে আনার জন্য। 

এই অবস্থায় জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিলের আবেদন করবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস ও সুব্রত বাইনের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এই অপরাধীরা দীর্ঘ বছর কারাগারে কাটানোর পরও নিজেদের সংশোধন করেনি। তারা এমনভাবে চাঁদাবাজি ও গ্যাং কার্যক্রম শুরু করেছে যেন কিছুই বদলায়নি।

জুলাই অভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত মূলত দেশে কোনো সরকার ছিল না। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক জন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পান। জানা গেছে, জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অন্তত ছয় জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। এদের প্রায় সবাই কমপক্ষে ১৫-২০ বছর ধরে কারাবন্দী ছিলেন। এদের মধ্যে আছেন—পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ইমন, মিরপুরের আব্বাস উদ্দিন (কিলার আব্বাস নামে পরিচিত), মোহাম্মদুপরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। এদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, একজন মানুষ তো সারা জীবন কারাগারে থাকতে পারে না। আদালত যদি জামিন দেয় তাহলে মুক্তিতে সমস্যা কী? জোর করে তো আর তাকে কারাগারে আটকে রাখা যাবে না। তবে হ্যাঁ, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তার দিকে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি যদি অপরাধ জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তো ভালো কথা। কিন্তু তিনি যদি আবারও অপরাধ জগতে ফিরে যান তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আবারও তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করবে।

২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘোষণা করেছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তার নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। তাকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে দলবল নিয়ে মহড়া দিয়েছে সুব্রত বাইন। একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। পরে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীকে ডেকে কথা বলেছেন। এ নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা সুব্রত বাইনকে প্রথমে চিনতে পারেননি। মুখে দাড়ি রেখেছেন, চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। তখন এক ব্যক্তি তাকে সুব্রত বাইন বলে পরিচয় করিয়ে দেন।

পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে ঐ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার দখল নিতে সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের বিরোধ থেকে জোড়া খুনের ঐ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর পিচ্চি হেলালকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোহাম্মদপুরের খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলাল গ্রেফতার না হলেও দুই-তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন।

চাঁদা না পেয়ে দখলের চেষ্টা করা হচ্ছিল মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার। সেটাও সম্ভব হয়নি ব্যবসায়ীদের কারণে। ক্ষোভ থেকেই গত ১০ জানুয়ারি রাতে টার্গেট করে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে কোপানো হয় দুই ব্যবসায়ীকে। তবে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম, যারা একসময় অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তারা হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। যারা গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর জামিনে বের হন। এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেসামুল হককে কোপানো হয়। এ ঘটনার ১০-১২ সেকেন্ডের কোপানোর নৃশংস একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী ওয়াহেদুল হাসান দীপু হলেন ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের বড় ভাই।

এই ঘটনায় মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে মিথুন (৩৫) নামে এক ছাত্রদল নেতাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাকে ছিনিয়ে নিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা গতকাল শুক্রবার ভোরে রাজধানীর নিউমার্কেট থানার সামনে হামলা চালায়। মিথুন ছাত্রদল নেতা হলেও ইমনের বাহিনীর হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। এই ঘটনার পর মিথুনকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার মোহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় নিউ মার্কেট থানায় একটি মামলা হয়। তাতে আসামির তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনসহ অনেকের নাম রয়েছে। পুলিশ দুই জনকে গ্রেফতারও করে। তাদের দেওয়া তথ্যে পুলিশ নিশ্চিত হয় এ ঘটনার নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজিদুল ইসলাম ইমন ও তার প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ হোসাইন মিথুন রয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে মিথুনকে ৩০০ ফিট থেকে গ্রেফতার করা হয়।

জানা গেছে, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট, কলাবাগানসহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইমন বাহিনী। ইতিমধ্যে ২২টি বড় মার্কেট দখল করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে তার গ্রুপ।

রাজধানীর অপরাধজগত ও সন্ত্রাসী তত্পরতা নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। পুরোনো সহযোগীদের সংগঠিত করে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহের জন্য এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে পরিস্থিতি বুঝে এখন রাজনৈতিকভাবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণে রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button