চাঁদে খনন : পৃথিবীর বাইরে সম্ভাবনার দিগন্ত

চাঁদে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মানব সভ্যতা। এই দশকের শেষ নাগাদ চাঁদে খনন কার্যক্রম শুরু হতে পারে, যেখানে দেশগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতায় নামবে। তবে এই কর্মযজ্ঞ শুরুর আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কী ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সেখানে অনুমোদন দেওয়া উচিত এবং কীভাবে তা মানবজাতির মঙ্গলের জন্য পরিচালনা করা যাবে।
নাসার মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের আর্টেমিস প্রোগ্রাম শুধু চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভবিষ্যতের খনন কার্যক্রমের পথ সুগম করার লক্ষ্যেও কাজ করছে। চীনও একই পথে এগোচ্ছে।
বর্তমানে মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম পৃথিবী থেকে পাঠানো হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক লিটার পানি চাঁদে পৌঁছাতে স্বর্ণের চেয়েও বেশি খরচ হয়। কিন্তু চাঁদে থাকা বরফকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে রূপান্তর করে মহাকাশযানগুলো সেখানে পুনরায় জ্বালানি ভরতে পারবে। এর ফলে মঙ্গলসহ আরও গভীর মহাকাশ অভিযান অনেক সহজতর হবে।
চাঁদে বিরল খনিজ পদার্থ, যা স্মার্টফোনসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য, সেগুলোর মজুদ পৃথিবীর উপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। তবে এই প্রতিযোগিতায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো মহাকাশ সংস্থাগুলোর আগেই খনিজ উত্তোলনে এগিয়ে যেতে পারে।
চাঁদ থেকে খনিজ উত্তোলনের ফলে ধুলার কণা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। চাঁদের বায়ুমণ্ডল না থাকায় এই ধুলা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি চাঁদের পৃষ্ঠের রঙ ও উজ্জ্বলতায় পরিবর্তন আনতে পারে। তাই টেকসই এবং পরিবেশ-বান্ধব খনন প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটি অনুযায়ী, কোনো দেশ চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারে না। তবে চাঁদ থেকে সম্পদ উত্তোলন এই নীতির লঙ্ঘন কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।
১৯৭৯ সালের মুন ট্রিটি চাঁদের সম্পদকে “মানবজাতির অভিন্ন ঐতিহ্য” হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বাণিজ্যিক খনন নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। তবে ২০২০ সালের আর্টেমিস অ্যাকর্ড খননকে অনুমোদন দিয়েছে, যদিও এটি মালিকানার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
চাঁদের সম্পদ থেকে লাভের ভাগ সবার মধ্যে বণ্টনের বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঁদের সম্পদ উত্তোলন এমনভাবে করা উচিত, যাতে সব দেশ এর সুফল পায়।
চাঁদে খনন কার্যক্রমে কর্মীরা দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন। স্বল্প মাধ্যাকর্ষণের কারণে হাড় ও পেশির ক্ষতি, হৃদরোগ এবং রক্তচাপজনিত সমস্যার পাশাপাশি মহাজাগতিক রশ্মি তাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, কর্মীদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে মহাকাশে ‘শোষণপ্রবণ’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই চাঁদে কাজের পরিবেশে শ্রমিকদের অধিকার, সুরক্ষা এবং ন্যায্যতার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
চাঁদের খনিজ সম্পদ মানব সভ্যতার জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে। তবে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, অপরিকল্পিত শোষণ বড় বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই চাঁদে খনন শুরুর আগেই মানবাধিকার, সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শক্তিশালী নিয়ম-কানুন তৈরি করা উচিত।